পিরিমকুল কাদিরভের “মোগল সিংহ বাবর ৫ * অনুবাদঃ সিদ্দিক মাহ্মুদুর রহমান

৫ ওশ


ওশের প্রানে- উঁচু পাহাড় আর সবুজ সমতলভূমির এই অপূর্ব মিলনস্থলে আজ কয়েকদিন হলো প্রাণের সাড়া জেগেছে। আন্দিজান থেকে উঠের পিঠে করে বয়ে আনা জাঁকজমকপূর্ণ ছাউনি ফেলা হয়েছে বারাতাগ পাহাড়ের নীচে, জান্নাত-আরিফ নদীর ধার বরাবর। আকবুরাসায়ের তীর বরাবরও শতশত ছাউনি পড়েছে সবুজ মাঠের ওপর। পাহাড় থেকে তাড়িয়ে আনা চমৎকার দুম্বা-ভেড়াগুলোকে মারা হয়েছে। শিককাবাব করার জন্য আংড়ায় জ্বলছে পেস্তাকাঠের কয়লা, বড় বড় লোহার ডেকচিতে মাংস সিদ্ধ হচ্ছে।
বাবরের অপেক্ষায় আছে সবাই। মির্জার অপেক্ষারত সরকারী ব্যক্তিদের মধ্যে মোল্লা ফজল উদ্দিনও আছেন। আজই তার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
ধূর্তামি করে উজীরে আজম হয়ে ইয়াকুব বেগ মোল্লা ফজল উদ্দিনকে অনেক দিন ধরে যেতে দিচ্ছিলেন না বাবরের কাছে। জাহাঙ্গীরের পক্ষে ষড়যন্ত্র করতে গিয়ে ধরা পড়ে ইয়াকুব বেগ- আহমদ তনবালই তাকে কাসিম বেগের নেতৃত্বে সৈন্যরা তাকে তাড়া করে ফিরেছে দিনরাত, শেষে সির-দরিয়ার তীরে ধরে ফেলে মুখোমুখি তীর বিনিময়ে মেরে ফেলে। কাসিম বেগ হলো উজীর, তাই মোল্লা ফজল উদ্দিন মির্জা বাবরের কাছে যাবার অনুমতি পেলেন। বড় কোন নির্মাণকাজের জন্য, যে সব মাদ্রাসার নকশা তিনি তৈরী করেছিলেন সেগুলি গ্রাস করলো, বললেন বাবর। মোল্লা ফজল উদ্দিনকে তিনি দায়িত্ব দিলেন ওশের সবচেয়ে উঁচু শৈলশিরায়, যেটি শহরকে যেন ঠেকা দিয়ে রেখেছে, বারান্দাসমেত একটি ছোট হুজরা তৈরী করতে। সেখান থেকে গোটা এলাকাটা চমৎকার দেখা যায়। অনেক মাস গেল, হুজরা বহুদিনই তৈরী হয়ে গিয়েছে, কিন’ মির্জা বাবর থাকায় আজই প্রথম এখানে আসবেন ভেবেছেন। যদি তার পছন্দ হয় হুজরাটা তবে মোল্লা ফজল উদ্দিনের আরো বড় বড় পরিকল্পনা কার্যকরী হবার পথ খুলে যাবে। আর যদি মনে না ধরে…ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন মোল্লা ফজল উদ্দিন। হুজরাটা মির্জা বাবরকে দেখানো উচিত চমৎকার করে সাজানো অবস্থায়।
আগে থাকতেই শাহী কারিন্দাদের সেখান পাঠিয়ে দেওয়া হর্য়েছিলো। স্থপতি তাদের সঙ্গে নীচে গেলেন, নিজে বেছে নিলেন গালিচা ও বসবার আসনগুলি। এমন খাড়াই বেয়ে উঠতে অনভ্যস্ত নোকররা সেসব জিনিস পাহাড়ের ওপরে বয়ে আনতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। স্থূলকায় চোপদারটি (বইছে তো কেবল রূপোর এক সরুমুখ কাশগরী জলাধার) প্রতি দশ কদম অন্তর বিশ্রাম করার জন্য থামছে। মোল্লা ফজল উদ্দিনের মায়া হল তার জন্য, তার কাছ থেকে জলাধারটা নিয়ে তার হাত ধরে তাকে ওপরে নিয়ে গেলেন।
চোপদার বারান্দার সিঁড়ির ওপর রংচঙা গালিচা বিছিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন’ মোল্লা ফজল উদ্দিন সেটি তুলে নিতে বললেন, ‘পাথরের ওপর ফুলের নকশার কাজ- সে কোন গালিচা থেকে তা অনেক ভাল দেখাচ্ছে।’
পাহাড়ের চূড়া থেকে ওশ শহর আর আশপাশটা দেখাচ্ছে যেন হাতের তালুর মধ্যে সবকিছু। চোপদার তখনও হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে নীচে তাকাল আর তখনি লাফ দিয়ে উঠল, ‘ঐ যে ওঁরা এসে গেছেন।’
মোল্লা ফজল উদ্দিনও বারান্দার কিনারে এসে নীচে তাকালেন।
বাবর সাদা ঘোড়ায় চড়ে বেগ, অনুচরবৃন্দ ও ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের নিয়ে এগিয়ে আসছেন পাহাড়তলীর দিকে। দ্বিতীয় দলের আগে আছে তিনটি ঘোড়া জোতা একটি বন্ধ গাড়ী। কে আছেন ওতে? গোটা শোভাযাত্রাটা এসে থামল জান্নাত-আরিকের তীরে তরুণ মির্জার বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তৈরী করা ছাউনিগুলির সামনে। দামী রেশম, বনাত গালিচা ভরা, আসল রূপা দিয়ে তৈরী খুঁটির ওপর খাটানো এই ছাউনিগুলি ভোজউৎসব ও বিশ্রামের জন্য নির্দিষ্ট, তাই মোল্লা ফজল উদ্দিন ভাবলেন আজ তরুণ মির্জা নিশ্চয়ই ঐ ছাউনিগুলোতে আনন্দ-উপভোগ করবেন, হুজরা দেখতে আসবেন কাল। কিন’ এক ঘন্টাও গেল না, দাড়িওয়ালা দেহরক্ষী প্রধান চারজন সৈন্যকে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠে এলেন ।
‘শাহ্ এখন আসবেন এখানে। পালকি কোথায়?’
দাসদের প্রধান যেন সাহয্যের আশায় ফিরলো মোল্লা ফজল উদ্দিনের দিকে। মোটা তসর কাপড়ের নীল চোগার বুকের কাছটা এঁটে বুকের ওপর হাত জড়ো করে মোল্লা ফজল উদ্দিন দেহরক্ষী প্রধানকে বললেন, ‘মাফ করবেন হুজুর।’
‘কী?’
‘আমরা পরখ করে দেখেছি। এই চূড়ায় পালকি তোলা অসম্ভব। এমন কি ইঁটও তুলে আনা হয়েছে একটি একটি করে, সারি বেঁধে লোক দাঁড় করিয়ে। কিন’ পালকির জন্য চাই চারজন বেহারা।’
দেহরক্ষীপ্রধান জায়াগাটি ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলেন- তিনদিকে পাহাড়ের খাড়া পাথরের দেয়াল, একদিকে কেবল সরু পায়ে-চলা-পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে- যা একজন মানুষের চলার পক্ষেই অনুপযুক্ত, আর চারজনের তো কথাই ওঠে না। নোকরদের প্রধানের দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিক আছে। কিন’ প্রয়োজনের থেকে বেশী একজন লোকও যেন না থাকে।’
সরুপথটা এসে শেষ হয়েছে ঠিক বাড়ীটির সামনে, যেখানে বড় বড় পাথরের আড়ালে দেখা যায় একটা ছোট সমান চত্বর। সেখানে মির্জার হাতমুখ ধোবার জল দেবার জন্য একজন লোক দাঁড় করাতে হবে।
‘জনাব, আপনি এই পথ ভাল জানেন, যান বাদশাহকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসুন,’ আদেশ দিল দেহরক্ষীপ্রধান।
দেহরক্ষীপ্রধানের অবশ্য নিজেরই যাওয়া উচিত ছিল মির্জা বাবরের সঙ্গে আসার জন্য। কিন’ এমন খাড়া পাহাড়ে দু’বার ওঠা তার মত ভারী চেহারার লোকের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তাই মোল্লা ফজল উদ্দিনের সঙ্গে দু’জন সৈন্য দিয়ে নীচে পাঠাল সে, আর নিজে মসৃণকরা একটা পাথরের ওপর বসে পড়ে প্রচন্ড ঘামে ভিজে যাওয়া মোটা ঘাড়টা মুছতে লাগল।
মোল্লা ফজল উদ্দিন দিনে কয়েকবার বারাতাগ থেকে নামতেন আর উঠতেন। হালকা, চেপেবসা উঁচু জুতোজোড়া খুব সাহায্য করে সিঁড়ির মাপের মত এক পাথর থেকে আর এক পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে অভ্যস্ত দ্রুত গতিতে স্থপতি নীচে পৌঁছে গেলেন। এই সাক্ষাৎ তিনি কামনা করেছিলেন, কিন’ ভয়ও হচ্ছে।
মির্জা বাবর তার অনুচরবৃন্দ নিয়ে পাহাড়টিকে পুবদিকে থেকে ভাল করে লক্ষ্য করলেন, তারপর দক্ষিণদিকে এসে ঘোড়া থামিয়ে নামলেন। প্রথম দলের পরে আসছে দ্বিতীয় দল- মহিলারা আসছেন বেগদের থেকে দূরে দূরে। ধীরসি’র কালো ঘোড়ার ওপর সাদা পোশাকপরা বাবরের মা কুতলুগ নিগর-খানম। একটি বাদামীরংয়ের কেশরের ছটফটে ঘোড়ার ওপর সোনালী কাবা পরনে খানজাদা বেগম বসে আছে। মোল্লা ফজল উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলেন। হালকাভাবে ঘোড়ার ওপর বসে থাকার ভঙ্গীটি ভারী মধুর, আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ; বুকের ধুকধুকানির গতি দ্রুত হল তার, আগের উদ্বেগের অধীর হয়ে পড়লেন তিনি, যখন মির্জা বাবর ও তার অনুচরদের দিকে এগিয়ে গেলেন সে উদ্বেগ চেপে রাখতে কম বেগ পেতে হল না তাকে। তাদের থেকে কয়েক পা দূরে থেমে কুর্ণিশ করে, বুকের ওপর হাতজোড় করে, চোখ আড়াল করলেন।
মির্জা বাবরের বড় বোন খানজাদা বেগমের অসাধারণত্বে বিস্মিত হয়েছেন মোল্লা ফজল উদ্দিন অনেক বারই। চারবছর আগে হীরাট থেকে ফিরে যখন আন্দিজানে ওমর শেখের জন্য বাগানবাড়ী তৈরী করতে আরম্ভ করেন খানজাদা বেগমের তখন তার বয়স মাত্র ষোল। খানজাদা বেগম শাহ পরিবারের মেয়েদের মধ্যে সেরা সুন্দরী। একবার মোল্লা ফজল উদ্দিন প্রচন্ড অবাক হয়েছিলেন দেখে যে খানজাদা বেগম পুরুষের পোশাক পরে লাফিয়ে ঘোড়ায় উঠে ভাইয়ের অনুচরবৃন্দদের সঙ্গে চৌগান খেলতে লাগলেন। সে কি খেলা! কিছুদিন বাদে মোল্লা ফজল উদ্দিনকে আন্দিজান ডেকে পাঠানো হয় প্রাসাদের দেওয়ালের কয়েক জায়গায় নতুন করে রঙ করার জন্য। তখন তিনি সতের বছরের খানজাদা বেগমকে দেখেন মেয়েদের সঙ্গে চঙ্গ বাজাতে। সেই অসি’র চৌগান খেলোয়াড় চঙ্গতে কোমল, সূক্ষ্ম, কঠিন সুর তুলছে, তাকে এমন কোমল ও সুন্দর দেখাচ্ছে যে মোল্লা ফজল উদ্দিন সবকিছু ভুলে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
আর একটি ঘটনাও তার কম বিস্ময় উদ্রেক করে নি।… প্রাসাদের দেওয়ালে অলঙ্করণের খসড়া করছিলেন তিনি, এমন সময় খানজাদা বেগম এগিয়ে এসে গভীর আগ্রহে লক্ষ্য করতে লাগলেন তার কাজ। উত্তেজনায় ফজল উদ্দিনের হাত থেকে বৃত্ত আঁকার যন্ত্রটা খসে পড়ল।
‘চমৎকার নকশা একেছেন আপনি, কিন’ বোধহয় আপনার আঁকায় আমার নজর লেগে গেছে’, বলে এই অস্বসি-কর পরিসি’তি সৃষ্টির সব দোষটা নিজের ঘাড়ে নিলেন।
মোল্লা ফজল উদ্দিন মাটি থেকে যন্ত্রটা কুড়িয়ে নিতে নিতে একটা লাগসই উত্তর বার করলেন, ‘না বেগম ঠিক তার উল্টো, যে অলঙ্করণে আপনার দৃষ্টি পড়ে, তা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।’
‘আমি শুনেছি, মওলানা, আপনি অঙ্কনশিল্পীও?’
‘স্থপাতিকে অঙ্কনবিদ্যা জানতে হয় বেগম।’
‘তাহলে, মওলানা, আমার তসবীর আঁকতে চেষ্টা করুন।’
কি অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব! মওলানা তাড়াতাড়ি চারদিকে তাকিয়ে নিলেন, যদিও প্রাসাদের এই অংশে তারা ছাড়া তার কেউ নেই, গলা নামিয়ে বললেন, ‘মনে প্রাণে খুশি হতাম… কিন’…’
‘ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি কথা গোপন রাখতে জানি।’
‘আর যদি এই তসবীর আঁকার জন্য… কেয়ামতের দিনে যখন আমার রুহ্ তলব করা হবে তখন… কোথায় আমি তা পাব যদি ইহলোকেই হারিয়ে ফেলি?… আমি যে তা হারিয়ে ফেলছি, বেগম?’
খানজাদা বেগম একথার গূঢ় অর্থ বুঝলেন, মোহিনী হাসি হেসে বললেন, ‘আমার তসবীরের বদলে যদি আপনার রুহ্ দিতে হয় তাহলে আমাকে বলবেন, আমি আমারটা দেব আপনাকে।’
… যে ছবিটা তার সিন্দুকের নীচে পড়ে আছে, সেটি তিনি আঁকতে সাহস করেছিলেন সেই মনোমুদ্ধকর ছলাকলাপূর্ণ সুন্দর কথা শোনার পর।

যুদ্ধের সময়ের গোলমালে আর যুদ্ধ পরবর্তী দিনগুলিতে খানজাদা বেগমের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি তার।
শেষে, গতবছরের শরৎকালে হঠাৎ খানজাদা বেগম নিজেই তার কাছে বারাতাগে এসে উপসি’ত। বাবর অভিযানে বেরোবার সময় মাকে আর বড় বোনকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন ওশের নির্মাণকার্যের ওপর নজর রাখতে। তাই মেজান মাসে খানজাদা বেগম ওশ শহরে এসে পৌঁছলেন। বারাতাগ ওশ শহরের প্রানে- অবসি’ত।
মোল্লা ফজল উদ্দিন তখন কাজ করছিলেন তার একমাত্র সাকদেরকে নিয়ে। প্রতিটি ইঁট, প্রতিটি তক্তা, জলের প্রতিটি ঘড়া নীচে থেরেক ওপরে তোলা হতো অতি কষ্টে। মর্মর পাথরের টালি তৈরী করার জন্য মিস্ত্রী ছিল না। টালি কেনার মত সঙ্গতি ছিল না। এ সমস্ত কারণে ভীষণ অসুবিধায় পড়েছিলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন। কিন’ এ সব অভাবের কথা একটি যুবতীকে বলবেন? যিনি মুক্তোবসানো মাথার রেশমী টুপি থেকে আরম্ভ করে লাল, শুঁড়তোলা জুতোজোড়া পর্যন্ত সবকিছু মিলিয়ে কোমলতার প্রতিমূর্তি, সূক্ষ্ম, সম্পূর্ণ, দিব্য সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, তাকে বলবেন ইঁটের কথা? বিহ্বল স্থপতির জিভ সরে নি বলতে। খানজাদা বেগম নিজেই নির্মীয়মান বাড়ীটির নক্সা দেখতে চাইলেন মোল্লা ফজল উদ্দিনের কাছে।
‘গম্বুজটা ঢাকতে চাচ্ছেন মীনা করা টালি দিয়ে? যথেষ্ট আছে আপনার সে টালি?’ নক্সার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
মোল্লা ফজল উদ্দিনকে এবার বলতেই হলো তার প্রয়োজনের কথা। বাপরে! মেয়ে স্থপতিশিল্পেরও খবর রাখে। কত বই সে পড়েছে!
‘মির্জা বাবর অভিযানে জয়লাভ করে ফিরে এসে আব্বা হুজুরের স্বপ্ন সার্থক করবেন,’ দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বললেন খানজাদা বেগম। ‘আমরা অনেক কিছু নির্মাণ করবো আর তার পরিচালনা করবেন আপনি, মওলানা!’
তার গলার মত এমন স্নেহময় স্বর আর কোনদিনও বাজে নি মোল্লা ফজল উদ্দিনের কানে। এ এক সুখের প্রতিশ্রুতি, শাহ পরিবারে এমন একজন আছে যিনি স্থপতিশিল্পের অনেক কিছু জানেন, তাকে সম্মান করেন, বোঝার চেষ্টা করেন। কিন’ শুধু সেই কারণেই কি তার মনে বেগমের প্রতি কৃতজ্ঞতার এমন সুখানুভূতি?
খানজাদা বেগম হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
স্থপতি ভালই জানতেন যে খাড়াপাহাড় বেয়ে ওঠার চেয়ে নামা কঠিন। তাই খানজাদা বেগম নামার সময় তিনিও সঙ্গে চললেন। সে সরু পিছল পাথুরে পথটাকে লোকে দোজখ পুল বলতো তার কাছে এসে মেয়েটির মসৃণ চামড়ার তলীওয়ালা জুতোটা পিছলে গেল। ভারসাম্য হারিয়ে খানজাদা বেগম সামনে চলতে থাকা সহচরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। সহচরীও পিছলে গিয়ে আতঙ্কে চীৎকার করে উঠল। দু’জনেই যে কোন মুহূর্তে ফসকে পড়ে যেতে পারতো। মোল্লা ফজল উদ্দিন পাহাড়ী চিতার মত লাফিয়ে পড়লেন তাদের সামনে, দুটি মেয়েকেই ধরলেন।
যুবতী সহচরীটি আতঙ্কে তাকে আঁকড়ে তার কোমর জড়িয়ে থাকা পুরুষহস্তটির ওপর ভর দিলেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভারসাম্য এনে শান্তস্বরে বললেন ‘ধন্যবাদ’। মোল্লা ফজল উদ্দিন অনুভব করলেন খানজাদা বেগমের উষ্ণ নিঃশ্বাস আর আতরের খুশবু। নাকি সে খুশবু আতরের নয়? সেই খুশবু নাকে যেতে তিনি ভুলে গেলেন কে মেয়েটি, কোন পরিবারের। খানজাদা বেগম… মেয়েটির ঠান্ডা হাতটা শক্ত করে ধরলেন তিনি আর সমান জায়গায় এঁকেবেঁকে যাওয়া পথটা অবধি এসে না পৌঁছান পর্যন্ত ছাড়লেন না হাতটা। সে ছিল এক অপূর্ব, মায়ার স্বপ্ন, আর স্থায়ী হয়েছিল সে স্বপ্ন… পায়েচলা পথটার অর্ধেকও না।
পরের দিন খানজাদা বেগমের পাঠানো দুই শক্তিশালী যুবক নির্মাণকার্যে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ওপরে টেনে টেনে তুলতে লাগল। আরো এক সপ্তাহ পরে মীনা করা টালিবোঝাই উট এসে পৌঁছাল। প্রতিটি টালিতে মোল্লা ফজল উদ্দিন দেখতে পেলেন বেগমের প্রতিচ্ছবি। আর সন্ধ্যাগুলিতে যখন তিনি একা হয়ে যেতেন লোহার সিন্দুক থেকে ছবিটি বেরিয়ে আসত তখন।
এখন খানজাদা বেগম তার দিকে এগিয়ে আসছেন দেখে আবার উত্তেজনা অনুভব করলেন, আত্মপ্রকাশ না করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন তিনি।


ঘোড়া থেকে নামলেন মির্জা বাবর। বেশ বড় হয়ে উঠেছেন তিনি, ইতিমধ্যে যুবকে পরিণত হয়েছেন। এমন কি মোল্লার মতে, হাঁটা চলাতেও এসেছে এক গাম্ভীর্যপূর্ণ ছন্দ। আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, তিন বছর হল তিনি তখ্‌তে বসেছেন, চিন্তাভাবনা মানুষের বয়স বাড়িয়ে দেয়। যে-কোন বয়সের মানুষ পুরুষত্ব অর্জন করে। কেমলমাত্র ক্ষীণদেহ আর কাঁধের উঁচু হাড় জানিয়ে দিচ্ছে যে বাবরের বয়স মাত্র পনেরো বছর।
পাহাড়ে ওঠার পক্ষে পনেরো বছর বয়স খুবই সুবিধাজনক। সবাইকে ছাড়িয়ে বাবর পাথরে পা রেখে রেখে সহজেই উঠে যাচ্ছেন, খুব খাড়া অংশগুলিতে একবার মায়ের দিকে একবার বোনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন উঠতে সাহায্য করার জন্য। উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন পাত্রমিত্রদের অধিকাংশই নীচে রয়ে গেলেন! পথটা সরু, হুজরাটাও এত লোকের জায়গা হবে না। মির্জার সঙ্গে সঙ্গে উঠছেন তার সব থেকে অন্তরঙ্গ ব্যক্তি উজীর কাসিম বেগ, তার আড়ালে প্রাসাদে তাকে কবচিন বলে ডাকা হয়। কাসিম বেগের চেহারা স্থূলকায়, তাই সে মাঝপথ পর্যন্ত উঠেই হাঁপাতে লাগল। বাবর একটু থামলেন। কাসিমবেগ ফিরে তাকিয়ে সবার শেষে মোল্লা ফজল উদ্দিনকে ওপরে উঠতে দেখলেন। তাকে বললেন, এখানে সিঁড়ি খুদিয়ে নেওয়ার কথা আপনার মাথায় এল না জনাব।’
মোল্লা ফজল উদ্দিন সসম্ভ্রমে উত্তর দিলেন, ‘যদি বাদশাহের হুকুম হয়…’
একটা সমান পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে বাবর মৃদু হাসলেন, তরুণ ভাঙা ভাঙা গলায় স্থপতিকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আশ্চর্য! প্রাসাদের মত পাহাড়চূড়াতেও সিঁড়ি তৈরী করতে হবে নাকি?’
কাসিম বেগ ভদ্রতার সূক্ষ্ম রীতিনীতি না মেনে অভিযোগ জানালেন, ‘হুজুর, আপনার হুকুবরদারকে সিঁড়িও ঘাম থেকে বাঁচাতে পারবে না।’
কুতলুগ নিগর-খানম হেসে উঠলেন, ‘কাসিম বেগ, এমন পাহাড়চূড়ায় শাহ্, নোকর সবাইকেই পায়ে হেঁটে উঠতে হবে।’
‘এমন কি শাহনীদেরও।’ বোনের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা করে বললেন বাবর।
এইভাবে হাসিঠাট্টার মধ্যেই তারা এসে পৌঁছলেন হুজরাটার সামনের চত্বরে। নীল গম্ভুজওয়ালা ছোট্ট হুজরা বসনে-র সূর্যকিরণে এমন ঝলক দিচ্ছে যে সঙ্গে সঙ্গে উষ্ণতায়, উজ্জ্বলতায় ভরে গেল বাবরের প্রাণ। এখান থেকে চমৎকার দেখতে পাওয়া যায় চারপাশের সৌন্দর্য। দূরের পাহাড়, বসনে-র পবন, আর বারান্দার গরাদ ও থামগুলিতে অলঙ্করণের কাজ চোখকে আনন্দ দেয়, গম্বুজের রঙীন জমকাল টালিতে আলোছায়ার খেলা এ সব কিছুই মন ভরে দেয়।…
বাবর, তার মা ও বোনের সঙ্গে কাসিম বেগ বাড়ীর দরজা পর্যন্ত গিয়ে প্রবেশপথের মর্মরপাথরের সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। যেখানে অভিজাত মহিলারা রয়েছেন বাবরের অনুমতি ছাড়া সে সেখানে ঢুকতে পারে না। মোল্লা ফজল উদ্দিনও নীচে বারান্দার কাছে রয়ে গেলেন।
দরজায় কাঠের খোদাইয়ের ওপর সোনালী রংয়ের অলঙ্করণ। দেয়ালে আর কার্ণিসে অলঙ্করণগুলি ভাল করে দেখলেন বাবর, তারপর দরজা খুললেন। প্রথমে মাকে ও বোনকে ঢুকতে দিয়ে তারপর নিজে ঢুকলেন।
ভিতরে অন্ধকার ছিল না কিন’ ‘মেরাপের’ রেওয়াজ মোতাবেক একটি মোমবাতি জ্বলছিল সেখানে। জানলা দিয়ে এসে পড়া দিনের আলোয় প্রদীপের আলো প্রায় দেখাই যাচ্ছে না, কিন’ তার কাঁপা কাঁপা আলো দেয়ালে সোনালী অলঙ্করণের উপর পড়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। বাবর চমৎকৃত, উচ্ছ্বসিত হলেন। কুলুঙ্গীতে রাখা মোমবাতির আলোর চারপাশে লাল অলঙ্করণ দেখে বোনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কি ‘ইস্‌লিমে গুলখন’?’
খানজাদা বেগম পিছন ফিরে প্রবেশপথের দরজার উপরের অলঙ্করণটি দেখালেন, ‘ইস্‌লিমে গুলখন’ ঐ যে। আপনি ওটিকে ফুলের অলঙ্করণ ভেবেছেন।’
‘ইস্‌লিমে গুলখন’ … বলে যে অলঙ্করণটা দেখালেন খানজাদা বেগম তা সত্যি সত্যি আগুনের শিখার কথাই মনে করিয়ে দেয়। মানুষ যখন প্রবেশপথের কাছে আসে, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে তার দুঃখদুর্দশাও আসে, বাড়ীর মধ্যে ঢুকতে চায়, কিন’… তাদের থামায়, ভেতরে যেতে দেয় না রক্ষার আগুন।… কেন কে জানে বাবরের হঠাৎ মনে পড়ল প্রচীন প্রথা অনুযায়ী বরকনেকেও আগুনের চারদিকে ঘোরান হয়। এই সব বিষয়ে বোনের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার ভুল হয়েছিল।’
‘ভুল হওয়া স্বাভাবিক,’ এবার কুতলুগ নিগর-খানম যোগ দিলেন কথায়, ‘এখানে ফুলের অলঙ্করণ এমন উজ্জ্বল যে মনে হয় আগুন জ্বলছে।’
মাযের কথা বাবরের আনন্দ বাড়িয়ে দিলো আর যখন তারা ঘরগুলি থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার দিকে গেলেন, নীচে দাঁড়িয়ে থেকে মোল্লা ফজল উদ্দিন বাবরের মুখচোখ দেখে বুঝলেন মির্জা অত্যন্ত সন’ষ্ট ও আনন্দিত। তখুনি শুনতে পেলেন তার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর, ‘হুজরাটা বারাতাগের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে যায়, তাই না বেগ?’
ছেলেবেলা থেকেই বাবর ভালবাসেন বারাতাগ। সমতল উপত্যকার মাঝে এই উঁচু পাহাড়টা আল্লাহ্ তুলেছেন লোকের বিস্ময় জাগাবার জন্যই। সত্যিই যেন কি এক অলৌকিক শক্তি কোথা থেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে কোন এক বিশাল পাহাড়ের এই অংশটি, বসিয়েছে এই সমতলে, যেন চারপাশে ভাল করে দৃষ্টি চালাবার জন্যই।
বাবর বাদশাহ হবার পর তার নামের সঙ্গে জড়িত এই নির্মাণকাজ ছোট হলেও বাবরের কাছে তা অতি প্রিয়, গভীর চিন্তাধারায় পূর্ণ, ভবিষ্যতের পূর্বলক্ষণ। তার ভীষণ ইচ্ছা হতে লাগল যেন পাহাড়চূড়ায় এই বাড়িটি বহুদিন দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে তার কথা বলে। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে বাবর স্থপতির দিকে তাকালেন, ‘এখানে পাহাড়ে প্রচুর বৃষ্টি আর বরফ পড়ে। এমন জায়গায় বাড়ীটি দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকবে কি?’
কুতলুগ নিগর-খানম ও খানজাদা বেগমও চোখে গভীর আগ্রমে নিয়ে তাকালেন। মোল্লা ফজল উদ্দিনের হাঁটুজোড়া বিশ্বাসঘাতকতা করে কাঁপতে লাগল। মাথা নীচু করে বুকে হাত রাখলেন তিনি, ‘আল্লাহ্র মর্জি হলে দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে থাকবে।’
কাসিম বেগ তখুনি সে কথার খেই ধরল, ‘হ্যাঁ, চল্লিশ- পঞ্চাশ বছর।’
কিন’ মোল্লা ফজল উদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে তখুনি বুঝল তার মনে আঘাত দিয়েছে। মোল্লা ফজল উদ্দিনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন কিন’ নিজের মুখের ওপর মধুর স্নেহ পরশের মত কার যেন দৃষ্টি অনুভব করলেন। মাথা তুলে দেখলেন যে খানজাদা বেগম তার দিকে তাকিয়ে আছেন যেন মুখের ওপর চাপা দেওয়া সূক্ষ্ম রেশমী কাপড়টি ভেদ করে, সেই চাউনি যেন বলছে আত্মসংযম করতে। স্থপতি যেন আগুনে পড়লেন, জ্বলে উঠলেন (এবার তার গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাবে) নীচু হয়ে কুর্ণিশ করলেন সেই দিকে উদ্দেশ্য করে যেদিকে বেগম দাঁড়িয়েছিলেন।
খানজাদা বেগম বাবরকে বললেন, ‘শাহজাদা! সত্যিকারের একজন ওস্তাদ তৈরী করেছেন এই বাড়ীটি, বহু পুরুষ ধরে লোকে এটি দেখতে পাবে! দেখুন, যেখানে যেখানে বরফ বা বৃষ্টি পড়তে পারে, সে জায়গাগুলো মাজা পাথরে ঢাকা আর এর ভিত্তি পাহাড়ের মধ্যে এত শক্ত মজবুত করে বসান হয়েছে যে সেটা পাহাড়েরই অংশ হয়ে গেছে। মোল্লা ফজল উদ্দিনের নির্মাণ ক্ষমতা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। হীরাট ও সমরখন্দের সেরা স্থপতির মতই ঠিক।’
মির্জা বাবর যেন আন্দাজ করতে না পারেন যে খানদানী শাসকবংশের কন্যার প্রতি প্রেমে জ্বলতে থাকা এই সাধারণ স্থপতির বুকের মধ্যে কী হচ্ছে! কিছুতেই না! এ অত্যন্ত বিপজ্জনক, হতাশাব্যঞ্জক! আল্লাহ্র দোয়া, মাথা নীচু করে কুর্ণিশ করতেই হয়।… খানজাদা বেগমের আন্তরিক কথার উত্তরে আবার তিনি মাথা নোয়ালেন। কিন’ শুধু তো চোখের ঝিকিমিজি লুকানোই নয়, কথাও বলতে হবে সাবধানে মনে রেখে যে ছুরির ধারাল ফলার ওপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে।
‘হুজুরে আলী, আপনাকে জানাতে চাই যে এই নির্মাণকার্যে লাগান হয়েছে ঠিক সেই ধরণেরই পাথর, তৈলস্ফটিক, সেই চমৎকার টালিই যা সমরখন্দে উলুগ বেগের মাদ্রাসা তৈরী করতে লাগানো হয়েছে। খোদার রহমতে,’ সাবধানে বলে চললেন স্থপতি, ‘মির্জা বাবরের মর্যাদার উপযুক্ত এই হুজুরাটা বহুযুগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে।’
একথাগুলি বাবরকে আরো উদ্দীপিত করে তুললো, ‘খুদা করুন, তাই যেন হয়! হুজরাটার সৌন্দর্য সকল প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গেছে।’
‘প্রশংসার যোগ্য মোল্লা ফজল উদ্দিন!’ হতবুদ্ধি কাসিম বেগ বলল।
বাবর শুধরে দিলেন, ‘মওলানা ফজলুদ্দিন!’
তারপর ভৃত্যদের প্রধানের দিকে ফিরলেন, সে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছিল মুখে হাত জল দেবার লোকটির সঙ্গে। চীৎকার করে বাবর বললেন, ‘মওলানাকে খেলাত্ পরিয়ে দাও।’
ভৃত্যদের প্রধান ব্যস্ত হয়ে চাইল সঙ্গীর দিকে। কী হবে? খেলাতগুলি যে নীচে ছাউনিতে রয়ে গেছে। কাসিম বেগ গোলমালটা বুঝতে পারল। নিজের কিংখাপের চাপকানের সোনার সুতোর কাজ করা গলার কাছে হাত দিয়ে বোতাম খুলতে লাগল, ‘আদেশ করুন, হুজুরে আলী।’
এই উদারতা উপযুক্ত বিবেচনা করে বাবর মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে অনুমতি জানালেন।
‘মাওলানাকে আমাদের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হোক সাজসজ্জাসমেত একটি ঘোড়া।’ উদার হয়ে বললেন বাবর।
কয়েকজনের গলা একসঙ্গে শোনা গেল, ‘খেলাত্ পাওয়ার জন্য মুবারক জানাই, মওলানা। মুবারক জানাই।’
অন্য সব আওয়াজ ভেদ করে মোল্লার কানে সর্বপ্রথমে বাজল খানজাদা বেগমের কণ্ঠস্বর। তার দিকে তাকাবেন কি না ঠিক করতে না পেরে মাথা নীচু করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, কিন’ তাহলেও নিজেকে সবার থেকে সুখী বলে মনে হল।

সন্ধ্যাবেলায় বাবর বারাতাগের হুজরাতে একা রইলেন। কাসিম বেগ পাত্রমিত্রদের সংবাদ দিলেন যে বাবরের বিশ্রাম নেবার জায়গা হবে ঐ হুজরাতে। হয়তো আজ গোটা রাতই তিনি ওখানে কাটাবেন। দেহরক্ষীরা বিভিন্ন জায়গায় পাহারায় নিযুক্ত রইল, তারা চেষ্টা করতে লাগল বাবরের চোখে না পড়ার। বাবর অনেকক্ষণ ধরে বারান্দার ওপর থেকে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করলেন।
চারপাশ থেকেই বসন্ত নেমে আসছে ওশের ওপর। এখানকার বাতাস এমন পরিষ্কার যে নীচে উপত্যকায় জ্বালা আগুনের ধোঁয়াও কালো মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পাঁশুটে নীল। দূরের বরফঢাকা পাগাড়গুলি পর্যন্ত বিস্তৃত উপত্যকাটা যেন ঘন পান্নাসবুজের সমুদ্র। কোন্‌দিক উজগেন্দ কোন্‌দিক মার্গিলান, কোথায়- এখান থেকে অনেক দূরে- ইসফরা, খজেন্ত, কাসান, আখসি, তা আন্দাজ করতে করতে বাবর ভাবলেন এখন ঐ সব শহরের বাগানগুলি ফুলে ভরে গেছে। চারপাশের পর্বতমালার মাঝে ফরগানা উপত্যকা বড় সুন্দর, রূপকথার স্বর্গের মত, উপত্যকা কুসুমিত হয়ে নির্যাস ছড়ায়। ‘শানি- আর স্বসি- এলো তা’হলে’, একটু গর্ব নিয়েই ভাবলেন তরুণ মির্জা। যুদ্ধ থেমেছে প্রায় দু’বছর হলো, তিনি শেষপর্যন্ত সমরখন্দ শাসককে সন্ধি করতে বাধ্য করেছেন।
এমনি সব সময়ে বাবরের ইচ্ছা হতো কাগজ কলম নিয়ে বসতে। নোকররা হুজরাটার ভিতরে রেখে গেছে ছপায়াওয়ালা নীচু একটা মেজ, তার সামনে নরম আসনে বসলেন বাবর, খুললেন ‘সত্য ঘটনা’ শিরোনামা লেখা রোজনামচার একটি পাতা। শেষ যা লিখেছেন তা হল কানিবাদাম আর ইসফরায় তিনি যা দেখেছেন। পরিষ্কার অক্ষরে লিখতে লাগলেন ওশের প্রানে-… বারাতাগের চূড়ায় বারান্দাসমেত একটা ছোট হুজরা তৈরী করেছি আমি নয়শ বিরানব্বই হিজরী সনে। হুজরাটি দাঁড়িয়ে আছে চমৎকার এক জায়গায়, সারা শহর আর শহরের আশপাশ বাড়ীটির পায়ের তলায়…
নিবিষ্টমনে লিখছিলেন বাবর। বেগুনী রংয়ের রঙ্গন ও ঘন্টাফুল আর ওশের লালপাথর যে তাকে বিস্মিত করেছে সেকথাও তিনি ভোলেন নি।
এমন সময় দরজায় দেখাল গেল কাসিম বেগকে, ‘মাফ করবেন হুজুরে আলী, আপনার মহৎ কাজের সময় বিরক্ত করার জন্য। কিন’….বুখারার সুলতান আলি-খানের কাছ থেকে জরুরী খবর এসেছে।’
কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে কলম নামিয়ে রেখে বাবর কাসিমবেগকে ইঙ্গিতে ভেতরে আসতে বললেন। তার হাত থেকে গোল করে পাকানো মোহরছাপ দেওয়া চিঠিটা নিলেন। চিঠি পড়ে মাথা তুললেন বাবর, ‘সুলতান আলি-খান আমাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সমরখন্দ অভিযানে যাবার জন্য।’
আধাজিজ্ঞাসার ভঙ্গীতে বললেন তিনি।
‘সমরখন্দের সঙ্গে আমাদের সন্ধি হয়েছে, কিন’ সুলতান আখি-খানের সঙ্গে সামরিক মিত্রতা আছে হুজুরে আলী। অভিযান এড়ান যাবে না বলে আমার ধারণা।’
‘যুদ্ধের জন্য ব্যস্ত হবেন না উজীরে আজম। প্রথমে ওয়ালিদা সাহেবার অনুমতি পাওয়া দরকার।’
যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্তই বাবর মায়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে নেন না- এটা কাসিম বেগের ভাল লাগে না। কী জন্যে? জানা কথাই তো স্ত্রীলোকেরা যুদ্ধবিগ্রহ পছন্দ করে না……. অভিযান, লুঠপাট, লড়াই-এই হল বীর বেগদের যশ আনার উপায়, আর স্বেচ্ছাচারী, যুদ্ধবাজ বেগদের লাগাম টেনে রাখার এক প্রয়োজনীয় পথ। রুটিতে পেট ভরে না তাদের, ওদের কেবল তলোয়ার হাতে করতে দাও, সেগুলো বেশীদিন খাপে ভরা থাকলে মরচে ধরে যেতে পারে।
বাবরের পিছন পিছনে কাসিম বেগও কুতলুগ নিগর-খানমের ছাউনিতে ঢুকলেন। মুখে অসনে-াষের ছাপ, কিন’ ভাব দেখাচ্ছেন যেন তা খাড়া বারাতাগ পাহাড় থেকে নামার জন্য।
খানজাদা বেগমও ছিলেন মায়ের কাছে। ভৃত্যেরা বাবরের খাবার জায়গা করে দিল। সোনার থালায় করে শিককাবাব নিয়ে আসা হল। খাওয়া হল। কেউ কোন কথা বলছে না। কাবারের পরে কুমিস পান করা হয়। আবার সবাই চুপ। লম্বা গোঁফে লেগে থাকা সাদা কুমিসের ফোঁটাটা ঝেড়ে ফেরে দিয়ে কাসিম বেগ শেষ পর্যন্ত কথা আরম্ভ করল, ‘মির্জা সুলতান আখি-খানের সঙ্গে আমাদের বাদশাহের সমঝোতা হয়েছে। গরমের সময় আমাদের সৈন্য দিয়ে যাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমরা তাকে। গরমকাল এসে পড়ল বলে।’
‘খোদা আমাদের সুখে শানি-তে থাকতে দিয়েছেন,’ বললেন কুতলুগ নিগর-খানম, ‘আমাদের অবশ্যই মূল্য দেওয়া উচিত সেই দানকে মহামান্য কাসিম বেগ।… সুলতান আলি-খান নিজের ভাই মির্জা বাইসুনকুরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সমরখন্দের তখ্‌তের জন্য। আল্লাহ্ রহমতে আমাদের বাদশাহের নিজের তখ্ত আছে আন্দিজানে।’
কাসিম বেগ কোন কথা বলল না।
খানজাদা বেগম বললেন, ‘শাহজাদা, সমরখন্দের অভিযানে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হবে, তার বদলে আন্দিজানে নতুন নতুন প্রাসাদ, মাদ্রাসা তৈরী করলে হয় না? যদি আন্দিজান সৌন্দর্যে আর চাকচিক্যে সমরখন্দের সমান হয় তাহলে আপনার নামও ছড়িয়ে পড়বে মির্জা উলুগ বেগের মত, এই হল আপনার ভাগিনীর একমাত্র স্বপ্ন, আল্লাহ্ এ স্বপ্ন সার্থক করুন।’
বাবর মৃদু হাসলেন ঠাট্টার ছলে, ‘আন্দিজানকে সমরখন্দের সমকক্ষ করে তুলতে গেলে প্রথমেই নিজের চোখে সমরখন্দ দেখে আসা প্রয়োজন নয় কি? সমরখন্দের সঙ্গে পরিচিত হবো, তারপর…. আন্দিজানকে পড়ে তুলতে লাগা যাবে।’
বাবরের কথা কাসিম বেগকে আনন্দ দিল, ‘দানিশমন্দের মত কথাই বলেছেন, হুজুরে আলী!’
‘ছেলেবেলায় তুমি সমরখন্দ দেখ নি নাকি?’ কুতলুগ নিগর-খানম একমত হতে পারলেন না ছেলের সঙ্গে।
‘হ্যাঁ দেখেছি… পাঁচবছর বয়সে, এখন তার কিছুই মনে নেই।’
খানাজাদা বেগম কিছু মজা করার জন্য মনে করিয়ে দিলেন, ‘আর গত বছর? আপনি সমরখন্দ আভিযানে গেলেন, দীর্ঘ সাতমাস আপনার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।’
ভ্রু কুঁচকে উঠল বাবরের, ‘তা ঠিক, গতবছর অভিযানে গিয়েছিলাম আমরা…তিনমাস ধরে সমরখন্দের ধারেকাছে ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। সুলতান আহমদও এক সময় আন্দিজান ঢুকতে পারেন নি। আমার জন্যেও রাজধানীর শহরতোরণ বন্ধই রইলো।’
বাবরের গলার স্বরে ফুটে উঠল অপমান, কেঁপে উঠল গলা, সবাই আবার অনুভব করল, কী ছেলেমানুষ এখনও তিনি। অভিযান তাকে আকৃষ্ট করতো, হাতছানি দিতো তাকে তৈমুর, উলুগ বেগের মহান শহর। সমরখন্দের শাসক পরিবর্তন হয়েছে কয়েকবার, সুলতান আহমদের পর তার ভাই সুলতান মাহ্‌মুদ, এখন তখ্‌তে আছেন সুলতান মাহ্‌মুদের ছেলে মির্জা বাইসুনকুর, সেও তৈমুরের বংশধর, সেও উচ্চাকাঙ্খী, রণলিপ্সু, বয়সে যুবক (বাবরের থেকে পাঁচ বছর বড়)। পিতা যে তখ্ত দখল করেছিলেন, সে তখ্‌তের উত্তরাধিকারী হয়েছে সে, তার মানে তার তখ্‌তে বসা আইনসঙ্গত। আন্দিানের বেগরা কিন’ তার হাজার দোষ দেখতে পেতো, তার সম্বন্ধে কেবল খারাপ কথাই বলতো আর বাবরের কানের কাছে কেবলই শোনাতো একমাত্র তিনিই সমরখন্দের শাসক হবার উপযুক্ত। বাইসুনকুর জানতো বাবরের মনোভাব, ভয় ছিল তার বাবরকে। তাই বাবর যাতে শহরে ঢুকতে না পারেন তার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। ধূর্ত বাইসুনকুর বাবরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সমরখন্দের অতিথি হবার জন্য সৈন্যবাহিনী ছাড়া, কিন’ বাবর সে ফাঁদে পা দেন নি। এতে কেবল বিদ্বেষের আগুন জ্বললো বেশী করে, তাতে আরো ইন্ধন জোগাতে লাগলো দুপক্ষের রণলিপ্সু বেগরা।
কুতলুগ নিগর-খানমের ইচ্ছা নয় সে পনেরো বছর বয়সী বাবর অন্যদেশের আভ্যন্তরীণ কলহে মাথা গলান, তার ইচ্ছা তিনি যে নিজরাজ্যে শানি-তে রাজত্ব করেন। তিনি বাবরের অপমানে কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালেন, তারপর যেন সে অপমান ভুলিয়ে দেবার জন্য স্নেহমাখা সুরে বললেন, ‘বাবরজান, তোমার মা’র কথা বিশ্বাস কর, এই নশ্বর দুনিয়া নিয়ে তোমর মন খারাপ করা শোভা পায় না…’
ছেলেবেলায় তাকে যে নামে ডাকতেন সেই নামে আবার ডেকে মা যেন তাকে এক মুহূর্তের জন্য সেই মুক্ত দিনগুলির কথা মনে করিয়ে দিলেন যখন তিনি অভিযান, সিংহাসন কোন কিছুর কথাই ভাবতেন না। কিন’ বাবরজান অনেক দিনই আর নেই।
তাই মা আবার অন্য সুরে বলে চললেন, ‘এমন একদিন আসবে যখন সমরখন্দ জয়ের স্বপ্ন সফল হবে। এখন সবাই শানি-তে থাকতে চায়। কাসিম বেগের মত এমন দানিশমন্দ উজীর তোমার। এমন প্রতিভাবান স্থপতি যিনি ওশের শৈলাবাস তৈরী করেছেন, তিনি তোমার খিদমত করছেন। তোমার মা’র অনুরোধ তোমার কাছে: সমরখন্দ অভিযান কয়েক বছর স্থগিত রাখ।… খানজাদা ঠিক কথাই বলেছে,উপত্যকাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার কাজ হাতে নাও বরং; আন্দিজানে, মার্গিলানে, ওশে চমৎকার চমৎকার মহল, মাদ্রাসা তৈরী করাও।’
এমন দৃঢ় স্বরে অনেক দিন কথা বলেন নি কুতলুগ নিগর-খানম। মাথা নামিয়ে নিল কাসিম বেগ। বাবরের চোখ আটকে রইল পেয়ালার কুমিসের দিকে, মুখে পড়ে পেয়ালার কানার সোনালী রংয়ের আভা।
ঠিক কথা… কিন’ বেগরা কী বলবে? ভাবল কাসিম বেগ। আর সমরখন্দ? বেগদের কী বলব? ভাবলেন বাবর। খানজাদা বেগদের সুরেলা কণ্ঠ স্তব্ধতা ভঙ্গ করল, ‘শাহজাদা, নবাইয়ের কবিতা আপনার কণ্ঠস্থ। মনে করুন ফরহাদ কি অপূর্ব সব বাড়ী তৈরী করেছিলেন। আপনার ভাগিনীর চিরকালের স্বপ্ন আপনাকেঁজ ফরহাদের মতই স্রষ্টারূপে দেখার। এর থেকে পবিত্র, এর চেয়ে বড় আর কোন কাজই নেই পৃথিবীতে।’
বাবরের মনে পড়ল ওশের শৈলাবাসের সেই মুহূর্তগুলিতে কী সুখ তিনি অনুভব করেছিলেন। সমরখন্দ পালিয়ে যাবে না…. কিন’ ফরহাদের খ্যাতি-মহান খ্যাতি। তাছাড়া মায়ের কথাও সত্যি… কেবল বেগদের কি বলব?
কাসিম বেগের দিকে তাকালেন বাবর, ‘এ কি করা সম্ভব আমাদের পক্ষে?’
কাসিম বেগ বুঝল যে সমরখন্দ অভিযান স্থগিত রাখার কথা হচ্ছে। সাহসী যোদ্ধা হিসাবে ক্রোধ হল তার; রাজ্য শাসনের অংশগ্রহণকারী হিসাবে জানে যে বাবর অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাচ্ছেন। সবচেয়ে অভিজাত ও প্রতিপত্তিশালী বেগরা চাইছেন এই অভিযান; বহুদিন ধরেই অভিযানের প্রস্থতি চলছে। বাধা পার হয়ে লাফ দেবার জন্য সমস্ পেশী শক্ত হয়ে উঠেছে যে ঘোড়ার তা এখন থামনো আর সম্ভব নয়। যদি থামানোর মত শক্তি থাকে তো হয় ঘোড়া নিজের মেরুদন্ড ভাঙবে, না হয় তার আরোহী ছিটকে পড়বে। একথা সোজাসুজি না বলাই ভালো ভাবল কাসিম বেগ। বুকে হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ‘হুজুরে আলী, আপনার হুকুম বরদার এই পরিসি’তি থেকে পরিত্রাণের কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না।’
‘তার মানে মালিকা সাহেবার অনুরোধ প্রত্যাখান করব?’
কি চান উনি আমার কাছে? মনে মনে রাগ হল উজীরের। আজ মাকে, বোনকে খুশী করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, লড়াইয়ে যেতে, সামরিক কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে। বয়স কম, সেই কারণেই খামখেয়ালী। যেন এক দুর্বল শিশু অন্দরমহলের পরামর্শে চালিত। … যাই হোক কুতলুগ নিগর-খানমকেও একেবারে ছাঁটাই করে দিতে পারছে না কাসিম বেগ, নিজের চোখেই দেখেছে মায়ের গভীর প্রীতি তার জোয়ান ছেলের ওপর।
‘মালিকা সাহেবার হুকুমবরদার আমার কাছে পবিত্র আইন,’ বললো কাসিম বেগ। আপনার হুকুম বরদার কেবল বলতে চাইছে যে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমস্ত প্রতিপত্তিশালী বেগদের সমর্থন থাকা প্রয়োজন।’
কাসিম বেগের প্রতি বিশেষ প্রীতিপূর্ণভাব প্রদর্শনের জন্য তার নামের সঙ্গে ‘আমীর উল্-উমরা’ খেতাব যোগ করা হতো। কুতলুগ নিগর-খানমও তা ভোলেন নি।
‘জনাব আমীর উল্-উমরা,’ তার প্রতি মধুর হেসে বললেন তিনি, ‘মির্জা বাবরকে আপনি সাহায্য করবেন অন্যান্য বেগদের সমর্থন পেতে, ঠিক কিনা?’
‘মন্তপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব, মালিকা সাহেবা! কিন’ বেগদের মনের বাসনা একটু বুঝি আমি… আমাকে যদি অশিষ্ট, অমার্জিত বলে মনে না করেন তো বলি ওদের কথার যথার্থতা কোনখানে…’
‘বলুন।’
কাসিম বেগ একমুহূর্তের জন্য চোখ বুঁজে, ঘাড় টানটান করল, সাদার ছোঁয়াচ না লাগা কুচকুচে কালো দাড়ির প্রান্তভাগ উটের লোমের তৈরী দামী চেকমেনের গলার কাছে গিয়ে ঢুকল। তারপর সে সোজা হয়ে বসে মাথা তুলল। বাবরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল সে দোর্দন্ডপ্রতাপ আমীর তৈমুর ও প্রখ্যাত পন্ডিত মির্জা উলুগ বেগ সমরখন্দে চমৎকার সব নির্মাণকার্য চালাতে পেরেছিলেন তার কারণ হল তাদের হাতে ছিল বিরাট এক রাজ্যের ক্ষমতা ও ধনসম্মত্তি, এখন সেই বিরাট রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এই অপূর্ব ফরগানা যদিও বিশাল তবু কোন এক সময়ের এক ও শক্তিশালী মাভেররান্‌নহরের একটি অংশমাত্র।’
খানজাদা বেগম তখনি বুঝতে পারলেন যে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে কাসিম বেগ। জিজ্ঞেস করলেন, ‘জনাব আমীর-উল্ উমরা কি বলতে চান যে বড় বড় নির্মাণকার্য চালাবার ক্ষমতা আমাদের নেই?’
‘বেগম সাহেবা, আপনি বলছিলেন যে আন্দিজান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক বিশাল সমরখন্দের সঙ্গে। বেগরা বলতে পারেন তা করার জন্য রাজাকে পূর্বাস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তার প্রতিটি অংশ, যারা এখন স্বাধীন, সেগুলিকে একত্রিত করতে হবে একটি হাতের মুঠিতে, অভিযান বিনা কেমন করে তা সম্ভব, কার পতাকাতলে তাদের একত্রিত করা হবে? আপনার এই বিরাট নির্মাণকার্যের পরিকল্পনাকে রূপ দেওয়া সম্ভব নয় রাজ্য শতভাগে বিভক্ত বলে।’
বাবরকে পুরোপুরি রাজী করিয়ে ফেলেছে কাসিম বেগ, তিনি এখন উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে আছেন মায়ের দিকে। মা কী করে উজীরের যুক্তি খন্ডন করেন।
‘জনাব কাসিম বেগ, বিশাল বিশাল নির্মাণকাজ কেবল আমীর তৈমুর আর মির্জা উলুগ বেগই হাতে নেন নি। হীরাটে মীর আশিশের তিন মশহুর ইমারত-ইখ্লাসিয়া, খালাসিয়া, উন্‌সিয়া নির্মাণ করান। আর যিনি ছিলেন শাসকের একজন সলাহকারমাত্র সেই মীর আলিশারের চাইতে মির্জা বাবরের ক্ষমতা মোটেই কম নয়।’
‘ঠিক, ওয়ালিদা সাহেবা, ঠিক।’ কুতলুগ নিগর-খানমের কথাগুলি বাবরের অন্তরের অন্তরতম কোণে সুপ্ত থাকা বাসনাকে জাগিয়ে তুলল। প্রখ্যাত হবার, নিজের যশ ছড়াবার তারুণ্যের যে স্বপ্ন তার ছিল তাকে রূপ দেবার জন্য কখনও তিনি বিরাট যুদ্ধজয়ের কল্পনা করতেন, কখনও বা অপূর্ব কবিতা বা দস্তান সৃষ্টি করতেন মনে মনে। কিন’ যুদ্ধজয় করে কি নবাইয়ের মত মহান ব্যক্তির মান অর্জন করা যায়? তাছাড়া সৈনিকের যশও পরিবর্তনশীল, অত্যন্ত চঞ্চলও বটে। এই তো সমরখন্দের কাছ থেকে ঘুরে এলেন, সাতমাস ধরে কষ্ট পেয়েছেন, মহান জয়ের স্বপ্ন দুষপ্রাপ্য স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল। মহান কবি হলে কেমন হয়? কিন’ সেও যেন এক পাখী, অনধিগম্য উচ্চতায় উড়ছে, বাবর অনুভব করলেন সেই পাখীকে ধরার শক্তি তার নেই আপাতত। মা কিন’ আর একটি পথ বলে দিলেন আরো সহজ, যদি নবাই নির্মিত ইখলাসিয়া, খালাসিয়া, উন্‌সিয়ার খ্যাতি ফরগানা উপত্যকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তবে যুবক বাবর নির্মিত প্রাসাদগুলির খ্যাতি হীরাট পৌঁছতে পারবে না কেন? পারে।
নবাইয়েরও কানে যাবে সে খ্যাতি। জিজ্ঞাসা করবেন, বাবর আবার কে, তার সঙ্গে আগেভাগেই পরিচয় করে নিতে পারলে ভাল হয়। তারপর, হয়ত বাবর হীরাট যাবেন নয়ত নবাই এ অঞ্চলে আসবেন। হীরাটের বর্তমান শাসক হুসেন বাইকারার বর্তমান দরবার আলিশেরর ভাল লাগছে না বলে যে কানাঘুষা চলছে তা বাবরের অজানা নেই। হয়ত মহান কবি তার, বাবরের গুরুও হবেন!
হঠাৎ তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, গলার স্বরে ফুঠে উঠল শাসকের কর্তৃত্বময় সুর, ‘ওয়ালিদা সাহেবা ঠিক কথাই বলেছেন। বেগদের বোঝাতে হবে, উজীরে আজম!’
এ হলো ‘ফরমান’-আদেশ! কুতলুগ নিগর-খানম আর খানজাদা বেগমের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘কাসিম বেগ পরাভুত হয়েছে, হার মানবে সে এবার।’
কিন’ কাসিম বেগ নিজের মতে অটল, তার বিস্তৃত স্কন্ধের প্রাচীরের আড়ালে বড় বড় বেগরা আছে।
‘হুজুরে আলী, আপনার ফরমান অনুযায়ী কাজ আরম্ভ করার আগে বেগদেরও আরও একটি মনোবাসনা আপনাকে জানতে অনুমতি দিন।’
বাবর অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিলেন। জমকালো কালো গোঁফে হাত বোলালো কাসিম বেগ। নির্দ্বিধায় তাকাল খানজাদা বেগমের দিকে (যে ঔদ্ধত্য খুবই বিরল তার পক্ষে), ‘বেগম সাহেবা, আপনি যথার্থই অপূর্ব তুলনা দিয়েছেন আমাদের বাদশাহের সঙ্গে আজকের ফরহাদের। এই ফরহাদের খিদমতে নিযুক্ত বলে গর্বিত বেগরা। আমাদের স্বপ্ন,’ মৃদু হাসল উজীর, ‘ফরহাদ শিরীঁর মিলন করিয়ে দেওয়া।’ তারপরই মুখেচোখে গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘আর আপনার জানা আছে আমাদের শিরীঁ আজ সমরখন্দে, বেচারী, কষ্ট পাচ্ছে, বন্দিনীর মতো।’
বিভ্রান্ত বাবরের মুখে অল্প লালের ছোঁয়া লাগল। কাসিমবেগ অত্যন্ত সূক্ষ্ম সমস্যার উল্লেখ করেছে।
পাঁচবছর বয়সেই বাবরের বাগদান হয় সমরখন্দের শাসক সুলতান আহমদের কন্যা আয়ষার সঙ্গে। এই সুলতান আহমদের সৈন্যদলের প্রচন্ড ক্ষতি হয় কুভাসাই পার হবার সময়। এখন আয়ষার চৌদ্দ বছর বয়স। গত কয়েক বছর বাবর তাকে মোটেই দেখেন নি, কিন’ যে-ই দেখেছে সবাই একবাক্যে বলে তিনি তাজা গোলাপের কুঁড়ির থেকেও সুন্দর। এই সুন্দরী তরুণীই তার উদ্ধারকর্তা বাবরের অপেক্ষায় আছেন, বাবরকে যারা কাজে লাগাতেই চায়, তারাই তাকে এ খবর এসে দিয়েছে। উত্তেজিত বাবর চান বাইসুনকুরের অত্যাচারে জর্জরিত তার শিরীঁকে উদ্ধার করতে, সবাইকে তার যুদ্ধকৌশল দেখিয়ে উদ্ধার করতে। আয়ষা বেগমকে তার মনে নেই ঠিকই, কিন’ সেই তার পাঁচবছর বয়স থেকেই মনে আছে অন্য এক চমৎকার মেয়েকে, সুলতান আহমদের বাগদত্তাকে। কেন জানি মনে হয় আয়ষাও এখন তেমনই সুন্দরী।
প্রথা অনুযায় কনের মুখের ঢাকা সরাবে এক নিষ্পাপ বাচ্চা ছেলে। তখন কুতলুগ নিগর-খানম আতিথ্য নিয়েছিলেন সমরখন্দে: সুলতান আহমদের বিবাহে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি, পাঁচ বছরের বাবরও মায়ের সঙ্গে ছিলেন। সুলতান আহমদের ছেলেরা মারা গিয়েছে। যদিও কুতলুগ নিগর-খানমকে ঈর্ষা করত সবাই আর তার ছেলের দিকে বাঁকা চোখে দেখতো, তবুও তাকেই, সিংহের মত ছেলের জন্ম দেবে কনে- সবার এই উচ্ছ্বসিত শুভকামনার মধ্য দিয়ে বাবরকেই কনের মুখের ঢাকা খুলতে বলা হলো। সেই ঘটনার অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। কিন’ নিজের কেমন এক দুর্বোধ উত্তপ্ত অনুভূতি যা তিনি অনুভব করেছিলেন ছোট ছোট হাতে করে বউয়ের কোমল মুখ অনাবৃত করে দেবার সময়, তা মনে আছে। সেই থেকে সেই অনুভূতি তার বহুবার হয়েছে- সুন্দর কবিতা পড়ে, সুন্দর গান শুনে, চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে। আর চন্দ্রাননা সুন্দরীদের ছবি প্রায়ই তার মানসপটে ভেসে উঠে উদ্দীপিত করে তোলে তাকে স্বপনে জাগরণে। পাঁচ বছরের সেই ছেলেটি অবশ্যই নারী সৌন্দর্যের বিশেষ দিকটি বুঝত না, যদিও কনেবধুর সামনে নিজের যে উৎকণ্ঠা হয়েছিলো তা পরিষ্কার মনে আছে। তরুণ বাবরের কাছে সবাই যখন সমরখন্দের কন্যার প্রশংসা করতো বাবর তখন কল্পনা করতে পারতেন কেমন সে মেয়েটি, আয়ষা।…. সুলতান আহমদের কনের কথা আর বিভিন্ন বইয়ের নায়িকাদের কথাও মনে পড়ে। আয়ষাকে না দেখেই বাবর ইতিমধ্যেই তাকে ভালবাসেন- তার তরুণ মনের উদগ্র, সেই সঙ্গে কোমলপবিত্র কল্পনায়।
যদি সুন্দরী আয়ষা তার শত্রুদের হাতে বন্দীজীবন কাটাচ্ছেন- বাবর তা জেনে কি চুপ করে বসে থাকতে পারেন আন্দিজানে?
‘জনাব কাসিম বেগ,’ কুতলুগ নিগর-খানুম বললেন, ‘আমাদের মির্জার বাগদত্তার সম্পর্কে আমাদেরও কম উদ্বেগ নেই। আমরা তার মাকে লিখেছিলাম আয়ষা বেগমকে তার বড় বোন রাজিয়ার কাছে তাশখন্দে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ করে। সম্ভবত সে অনুরোধ ইতিমধ্যেই পুরণ করা হয়েছে…’
নেতিবাচক ভঙ্গীতে ঘাড় নাড়ল কাসিম বেগ, ‘দুঃখের বিষয়, হয় নি,’ বলল সে, ‘আপনার দাস হালে সমরখন্দ থেকে একটা চিঠি পেয়েছে। আমার এক বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়েছে সেটা… চিঠিটা সঙ্গে সঙ্গে হুজুর আলীকে দেখাতে সংকোচ বোধ করছিলাম।’
‘কী চিঠি? কিছু ঘটেছে নাকি?’ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন বাবরের মা।
আয়ষা বেগম তার মা ও বোনের সঙ্গে তাশখন্দ চলে যাবার যোগাড় করছিলেন কিন’ মির্জা বাইসুনকুর তাদের আটকেছেন, তাছাড়া তাদের বাড়ীর কাছে পাহারা বসিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, বাড়ী থেকে কাউকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। সত্যি- বন্দিনী। এখন তারা কেবল আন্দিজানের সাহায্যের অপেক্ষায় আছেন।
প্রচন্ড ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন বাবর। বেচারী মেয়েটির সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করার জন্য বাইসুনকুরকে সাজা দেওয়া উচিত। অন্য সব ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তখনি সৈন্যদল নিয়ে সমরখন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করার ইচ্ছা।
খানজাদা বেগম অনুভব করলেন ভাইয়ের মনের অবস্থার কি পরিবর্তন হয়েছে।
‘খোদা আপনার সহায় হোন বন্দিনীদের দ্রুত উদ্ধার করতে,’ বললেন তিনি। ‘কিন’ কেবল যুদ্ধ বিগ্রহের সাহায্যেই কি উদ্ধার করা যায়? সমরাভিযান কি শত্রুতা আরো বাড়িয়েই দেয় না? মির্জা বাইসুনকুর যখন জানতে পারবেন আপনার অভিযানের কথা তখন আয়ষাকে আরো ঘৃণ্য করবেন। হয়ত শানি-পূর্ণ উপায়ে তাকে উদ্ধার করাই উচিত, হুজুর….’
একথায় বাবরের রাগ বেড়ে গেল।
বাবরের মা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মির্জা বাইসুনকুরের কাছে শানি-র দূত পাঠাও, বাছা আমার।… তোমাদের মধ্যের বিবাদ মেটান অসম্ভব নয়।’
যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেলে শানি-র কথা কী করে বলা যায়? যে পক্ষ দুর্বল বলে মনে করা হয় সে পক্ষই প্রথম শানি- প্রস্তাব দেয়। সে বাইসুনকুরের চেয়ে দুর্বল নয়।
‘বাইসুনকুর অত্যাচার চালাচ্ছে। আর আমি তা মেনে নিয়ে শানি-র প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠাব? আয়ষাকে শাদী করার জন্য বাইসুনকুরের সামনে নতজানু হতে হবে? না, তা হবে না, আঘাতের উত্তরে আঘাতই হানতে হয়।’
‘মালিকা সাহেবা, আজকের জমানায় শানি- দিয়ে জুলুমকে জয় করা যায় না।’ কাসিম বেগ বাবরের দিকে তাকাল। ‘এখন প্রয়োজন শক্তিমানের মধ্যে সর্বশক্তিমান হওয়া। তাছাড়া কথা হচ্ছে যেমন তেমন কিছু নিয়ে নয়, সমরখন্দ নিয়ে। সবাই এগোচ্ছে সমরখন্দের দিকে, সবাই চাইছে সমরখন্দ। উত্তর দিক থেকে শয়বানী খান তাক্ করে আছে। হীসারের বাদশাহ খস্‌রু সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সমরখন্দের ওপর। মির্জা বাইসুনকুর দুর্বল শাসক, মাভেরান্‌নহরে রাজধানী ধরে রাখতে পারবেন না তিনি। যদি আমাদের বাদশাহ সে রাজধানী দখল না করেন তো অন্যরা দখল করবে- তার পুর্বপুরুষের গর্বের রাজধানী চলে যাবে অন্য বংশের দখলে। আর যদি শয়বানী বা খসরু সমরখন্দ দখল করে তো তাদের শক্তি এত বাড়বে যে আন্দিজানের পক্ষেও… আমাদেরও অবস্থা আরো কঠিন হবে তখন। সময় নষ্ট করলে চলবে না কিছুতেই।’
‘আমীর তৈমুরের সব বংশধররা মিলিত হয়ে সামরিক সন্ধি করা যায় না?’ জিজ্ঞাসা করলেন কুতলুগ নিগর-খানম আর বিষন্ন মনে প্রতীক্ষা করে রইলেন সেই উত্তরের যা তার নিজেরও জানা ছিল।
‘কার নেতৃত্বে, কার পতাকাতলে? কোন্ শক্তি তাদের একত্রিত করবে? বাইসুনকুরের শক্তি, বুদ্ধি কিছুই নেই। মাভেরন্‌নহরকে রক্ষা করতে পারেন কেবল আমাদের বাদশাহ- মির্জা বাবর। এই উদ্দেশ্যেই আমরা আমাদের সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছি, আমাদের বাদশাহের খিদমতে লেগেছি। এ বছর যদি সমরখন্দ দখল করি, আল্লাহ্র দোয়ায় আর বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না, তখন সত্যিকারের শানি-ও স্বসি- আসবে। আর সময়ও থাকবে যে-কোন ধরনের মহল তৈরীর জন্য।’
খানজাদা বেগম কল্পনার পাখা মেলে উড়তে থাকা উজীরকে চীৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর মানে- এক কথায়, বেগদের বোঝাবার জন্য আমাদের ওয়ালিদা সাহেবা যে অনুরোধ জানিয়েছেন আপনি তা প্রত্যাখ্যান করছেন?’
কাসিম বেগ সসম্মানে বুকে হাত রাখল, ‘অযোগ্য দাসকে তার অকপটতার জন্য ক্ষমা করবেন, বেগম, কিন’ আমাদের হুজুরে আলীর অনুমতি নিয়েই আমি আমার মনে যা ছিল তা বলেছি।’
দুই আগুনের মাঝে পড়লেন বাবর। সন্ধি স্থাপন কর, নির্মাণকাজ চালাও। মা বলছেন। তার অর্থ হল, হরিণের মত দায়িত্বহীন জীবন যাপন কর। কিন’ কাসিম বেগ ঠিকই বলছে বর্তমান জগতে শানি-তে বাস করা সম্ভব নয়। হিংস্র নেকড়ের দলের মাঝে হরিণ বেশীদিন বাঁচতে পারে না, নেকড়ের দলের মাঝে হতে হবে সিংহ।
এই দীর্ঘ, শক্তিক্ষয়কারী আলোচনা বন্ধ করতে সিদ্ধান্ত নিলো কাসিম বেগ।
‘হুজুরে আলী, আপনি আজ ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যাবেন বলেছিলেন। ঘোড়া বহুক্ষণ তৈরী।… মালিকা সহেবার প্রস্তাব আজ সন্ধ্যায় সব বেগদের সঙ্গে একত্রে আলোচনা করা যায় না কি? বেগদের এক বড় সভা ডাকা যাবে…’
খানজাদা বেগম মায়ের সঙ্গে ক্ষিপ্র দৃষ্টি বিনিময় করলেন। একজন বেগকে বোঝান গেল না, আর সব বেগকে বোঝান? কুতলুগ নিগর-খানম চিন্তায় পড়লেন কী করে কথাবার্তা চালানো যায় এরপর, কিন’ বাবর তরুণসুলভ ক্ষিপ্রতায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সভা কাল ডাকা যাবে, ভাল করে সবকিছু চিন্তা করা দরকার। এখন ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে আসা দরকার…’

ওশের থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত ছোট ছোট টিলাভরা সমতলভূমি, আশ্চর্য উজ্জ্বল মেঠোফুলে- নীলচে-বেগুনী ঘন্টাফুলে, লাল পোস্তফুলে ঢাকা।
বাবরের ঘোড়া চলেছে ধীরে সুসে’; দূরের বরফঢাকা পাহাড়চূড়া থেকে চোখ সরাচ্ছেন না বাবর। সেই সঙ্গেই অনুভব করছেন যে লম্বা ঘাসের ওপর ঘোড়া কেমন নরমভাবে পা ফেলছে। বসনে-র সৌন্দর্য চোখ আর মন ভরিয়ে দিচ্ছে। কিন’ মন তার শান্ত হচ্ছে না, মায়ের আর উজীরের মধ্যে, নিজের মধ্যেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে কঠিন বিবাদ। নিজের মধ্যে যে তর্ক-বিবাদ তা জট তিনি নিজে খুলতে পারবেন না। এমন কোন জ্ঞানী ব্যক্তি আছেন না কি যিনি এই জট খুলতে দেবেন ঠিক তেমনি ভাবে যেমন বাবর চান? কেমনভাবে তিনি চান? পীরের সঙ্গে কথা বলবেন নাকি? অসুস্থ হয়ে পড়ায় খাজা আবদুল্লাহ ওশে আসতে পারেন নি, কিন’ বাবর জানেন তিনিও সমরখন্দ অভিযানের পক্ষেই ছিলেন। মওলানার কাছে তিনি একথা বহুবার শুনেছেন যে, যতদিন মাভেরন্নহর একত্রিত না হবে ততদিন যে-কোন বড় স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তার মানে আবার যুদ্ধ, আর নির্মাণকাজ স্থগিত রাখতে হবে।… অনির্দিষ্টকালের জন্য।
অশ্বারোহী পাহাড়ের ঢালের ওপর উঠলো। এখান থেকে চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়। পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কাসিম বেগের মুখ দিয়ে বিস্ময় ধ্বনি বেরিয়ে এল, ‘কত ভেড়ার পাল।’
সত্যিই পশ্চিম দিকে দেখা যাচ্ছে গোটা দশেক টিলার ওপর থেকে নেমে আসছে ভেড়ার পাল। অনেক অনেক পাল। খাজা কালান বেগ চোখের ওপর হাত আড়াল করে দূরে তাকাল।
‘উ-হু-হু!’ বিস্ময় ধ্বনি করে উঠল সে। আরো বড় বড় ঘোড়ার পাল আছে।’
‘ঘোড়ার পাল পূর্বদিকেও, দেখুন দেখুন।’
ঘোড়া আর ভেড়ার পাল এগিয়ে আসছে দ্রুত। তার মানে ওরা চরছে না- ওদের তাড়িয়ে আনা হচ্ছে। ঐ তো দুটি ভেড়ার পাল দেখা যাচ্ছে ঢালে। তারপর আরো দুটি। দূরের পাহাড়গুলির ওপার থেকে একের পর এক ছুটে বেরিয়ে এল চারটি ঘোড়ার পাল আর দ্রুত ছুটে চললো ঢালের দিকে যেখানে বাবর তার অনুচরবৃন্দ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঁদিক থেকে আরো ঘোড়ার পাল এগিয়ে আসতে লাগল। ঘোড়া আর ভেড়ার পালগুলি ওশের দিকে এগিয়ে আসছে। তারপর হানা দিতে গিয়েছিল- তারাই ফিরে আসছে। খুশীতে চীৎকার করে কাসিম বেগ বলল, ‘কী দারুণ শিকার!’
খাজা কালানও উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আশ্চর্য! বিশাল!’
সবাই উল্লসিত হয়ে উঠল। হবে না আবার! এই ভেড়া আর ঘোড়ার পালের এক পঞ্চমাংশ যায় বাদশাহের ভাগে আর বাকী অংশ ভাগ করে দেওয়া হয় বেগ ও দরবারের অন্যান্য উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে। এ যেন আকাশ থেকে পাওয়া ধন! বেগরা আনন্দ চাপতে পারছে না।
বাবর ঘোড়া ফেরালেন তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকা অশ্বারোহী বাহিনীর দিকে। লাগাম ঢিলে করে দিলেন, ঘোড়াটি উড়ে চলল পক্ষীরাজের মত। বেগরাও দৌড় দিলেন তার পিছনে পিছনে, এক টিলা থেকে আর এক টিলায়। একটি টিলার ওপর থামলেন বাবর।
বাহিনীর আগে আগে আসছে আহমদ তনবাল, বর্মঢাকা শরীর। বুকের বাঁদিক আর বাম কাঁধ আড়াল করা ঢালটায় রোদ পড়ে চকচক করছে। আহমদের ঘাড়ে তীর লেগেছে, ক্ষতস্থানটা বেঁধেছে সে একটুরো সবুজ রংয়ের কাপড় দিয়ে। মুখচোখ বসে গেছে তার, গালে হাড়দুটো আরো উঁচু দেখাচ্ছে।
বাবরের থেকে পঞ্চাশ পা দূরে ঘোড়া থেকে নামল সে, নতজানু হয়ে বসে সামনের মাটি চুম্বন করল, ‘হুজুরে আলী, আমাদের দুশমন চাগ্রাকদের সাজা দেওয়া হয়েছে কর না দেওয়ার জন্য। ওদের থেকে নিয়ে নিয়েছি ষোল হাজার ভেড়া আর আড়াই হাজার ঘোড়া।’
‘অভিযান ভালোয় ভালোয় কেটেছে তো?’
‘ঐ হারামজাদা রাখালগুলো আদেশ মানতে চাইছিল না, হুজুরে আলী, ওরা বিদ্রোহ করে। আমাদের তিনজন সিপাহীকে মেরে ফেলে, দশজনকে ঘায়েল করে… কিন’ আমরাও খুব ভাল করে বদলা নিয়েছি।’ বলে আহমদ বাহিনীর পুরোভাগে চলতে থাকা এক তাগড়াই চেহারার যুবককে ইঙ্গিতে ডাকল।
যুবকটি ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বাধা বস্তাটি নিয়ে লাফিয়ে নেমে এল ঘোড়া থেকে, মির্জার দিকে এগিয়ে এলো। মোটা কাপড় দিয়ে সেলাই করা বস্তাটা রক্তে মাখামাখি। সৈন্যটা বস্তা থেকে ঢেলে দিল কতকগুলো মানুষের কাটা মাথা। আহমদ তনবাল গুনতে লাগল, পনেরোটা। কেন কে জানে বাবর ভাবলেন, চাগ্রাকরা আমাদেরই তুর্কভাষী… আর আমরা ওদের… গায়ে কাঁটা দিল। নিজেকে বোঝাতে তনবাল তা করেছে, ওরা তুর্কভাষী, একই পরিবারের লোক, কিন’ কর দিতে হবে আত্মীয়স্বজনকেও। কিন’ এই চাগ্রাকরা তার শাসন মানে না, তার কর-আদায়কারীদের ওপর তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নিজেরাই এখন ঐ মুন্ডুগুলোর একটার… ওদের একজনের দাড়ি ওঠে নি, মসৃণ হলদেটে মুখ, সবে গোঁফ উঠতে আরম্ভ করেছিল। চাগ্রাক তরুণটির বয়স সতেরো বছরের বেশী নয় কিছুতেই। ঘাড়ের একেবারে শুরু যেখানে সেখানে কেটে ফেলা হয়েছে তার মাথাটা। বাবরের মুখ মলিন হয়ে গেল। কাসিমবেগের দিকে ফিরলেন। কোন বথা বললেন না।
আহমদ তনবাল ও তার সিপাহীরা বাবরের কাছে প্রশংসা ও পুরষ্কার পাবার প্রত্যাশায় আছে। ষোল হাজার ভেড়া, আড়াই হাজার ঘোড়া কম কথা নাকি! তিনজন সৈন্য মরেছে ঠিকই, কিন’ তার বদলে ঐ তো প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে, পনেরোটা কাটা মাথা গড়াগড়ি খাচ্ছে ঘাসে পড়ে। আর সাহস প্রদর্শন করেছে তারা মাত্র এই ক’জনকেই হত্যা করে নয়। সাহসের জন্য উৎসাহিত করতেই হবে তাদের।
বাবরের মুখচোখ মলিন হয়ে যেতে দেখে উদ্বিগ্ন কাসিম বেগও তাই মনে করে। নিহত লোকেদের মাথা কেটে নেয়া একটা প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছর সমরখন্দের কাছে তরুণ শাহ্ অনেক কাটা মাথা দেখেছেন। যখন কেউ বিশ্বাস করে না। এমন লোক আছে গল্প করেই বলে অনেক করেছে। আর এখানে যোদ্ধার কৃতিত্ব তো স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে; যোদ্ধা কাটা মাথার পরিমাণ দিয়ে বোঝাতে চাইছে যে দায়িত্ব পালন করেছে সে।
‘হুজুরে আলী,’ ফিসফিস করে বলল কাসিমবেগ, ‘আমি বলব?’
মাথা নাড়লেন বাবর। কাছে এগিয়ে এসে কাসিম বেগ আবার ফিসফিস করে বলল, ‘পুরস্কার হিসাবে যদি তলোয়ারটা দেওয়া হয়…. আপনি রাজী?’
বাবরের অস্ত্রবাহকের কাছে যত তরবারি ছিল তার মধ্যে একটি ছিল কোমরবন্ধে পরে আবার খুলে ফেলেছেন- বড় ভারী মনে হয়েছে। কিন’ এবার সেটিকে ঝুলিয়ে দিয়েছেন অস্ত্রবাহকের কোমরবন্ধে। বাবরের চোখের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সেটির ওপর, কাসিম বেগ বুঝল।
‘সম্মানিত বেগ,’ আহমদ তনবালকে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরে বলল, ‘এই বিশাল অভিযান শেষ করে আপনি ফিরে আসায় আমাদের প্রতি আপনার বিশ্বস্ততা কতদূর বিস্তৃত। আমাদের বাদশাহ এবং তার নিকটজনেরা সবাই বলছেন ‘ধন্য আপনি!’ বিজেতাদের সম্মানে ওশে বিরাট ভোজসভা হবে, সমস্ত বীর যোদ্ধারা উপযুক্ত পুরষ্কার পাবে। আর এখন আমাদের বাদশাহ মির্জা বাবর আপনাকে দান করছেন তার নিজের এই সোনার হাতল বসান তলোয়ারটি।
কাসিম বেগ অস্ত্রবাহকের হাত থেকে বাগদাদের তরবারিটি নিয়ে আহমদ তনবালের দিকে এগিয়ে দিল, আহমদ তনবাল, নতজানু হয়ে বসে উপহারটি তুলে ধরে খাপ থেকে তরবারিটি খুলে ধরে চার আঙুলের ওপর লম্বালম্বি রেখে ইস্পাতের ওপর চুম্বন করলো আর উদ্বেগে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘মৃত্যু পর্যন্ত আপনার উদারতা ভুলবো না মালিক, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনার খিদমত করার শপথ নিলাম।’

সেইদিন সন্ধ্যানাগাদ শহরের প্রানে- খাটানো শত শত তাঁবুর সামনে বেজে উঠল ঢাক, সানাই, জ্বলে উঠলো মশাল আর আগুন, আরম্ভ হল বিরাট উৎসব। বেগ, উচ্চমার্যাদসম্পন্ন ব্যক্তিরা, দাস্তসহচর, প্রাসাদের কর্মচারীরা- যেই ভেড়া বা ঘোড়া লাভ করেছে এই অভিযানের ফলে সেই আনন্দে মত্ত। বাবরের চমৎকার তাঁবুতে এসে উপসি’ত হয়েছেন সবচেয়ে খ্যাতি-মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রধান ভোজ উৎসবে। বাজিয়েরা বাজনা বাজিয়ে তাদের কান জুড়িয়ে দিচ্ছে, গায়ক তাদের শোনাচ্ছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ গানগুলি।
তাঁবুর ভেতরে বাবর বসেছিলেন একটু উঁচু মঞ্চের উপরে, চারধাপ গিলটি করা সোনার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় সেখানে। মির্জার নীচে, তার ডানদিকে সবচেয়ে সম্মানিত বেগদের মাঝে বসে আছে আহমদ তনবাল। যোদ্ধার পোশাকের বদলে এখন তার পরনে জরির চাপকান, রূপালী রংয়ের উষ্ণীষ আর সেই রংয়েরই কোমরবন্ধে ঝুলেছে বাবরের উপহার দেওয়া তরবারি। সবাই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে সফল অভিযান শেষ হওয়া আর পুরষ্কার পাওয়ার জন্য। আহমদ তনবালের সব থেকে প্রীতিকর মনে হয়েছে কুতলুগ নিগর-খানমের আর খানজাদা বেগমের অভিনন্দন জানানোটা- সে তাবুতে ঢুকতেই প্রথম যারা তাকে অভিনন্দন জানায় তারা তাদের মধ্যে ছিলেন। বাবরের মা ও বোন সেইদিকেই বসলেন আহমদের দিকে আধাআধি পাশ ফিরে; মাঝে মাঝে আহমদ তনবাল আড়চোখে তাকাচ্ছিল তাদের দিকে: বেগমের তন্বী দেহ, তার রামধনু রংয়ের রেশমের পোশাকের ঔজ্জ্বল্য ও প্রলোভন মাতাল করে তুলতে লাগলো বেগকে, তার সবচাইতে সুখের প্রত্যাশাকে প্রশ্রয় দিতে লাগল।
তরুণ বাদশাহের ভোজ উৎসবগুলিতে মদ পরিবেশিত হতো না। নিজে বাবর এ পর্যন্ত কখনও মদ চেখে দেখেন নি। কাসিম বেগ মদ পছন্দ করত না এবং এই সমস্ত অনুষ্ঠানে মদ খাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল সে। কিন’ অন্যান্য বেগরা মির্জা ওমর শেখের সঙ্গে আনন্দে কাটানো দিনগুলির কথা মনে করতে করতে বাবরের চোখের আড়ালে উজীরের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতো।
এই তো এখনই আলি দোস্ত বেগ মাথা তুলে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা শরবত পরিবেশককে চোখ টিপে ডেকে চোখের ভঙ্গীতে আহমদ তনবালকে দেখিয়ে দিলো। শরবত পরিবেশনকারী মৃদু হেসে বুঝিয়ে দিল যে সব বুঝেছে, তারপর অন্য একটা রূপোর পাত্র থেকে কাচের পেয়ালায় পানীয় ঢেলে দিলো। যখন আহমদ তনবাল হাতে পেয়ালা তুলে নিল, মদের গন্ধ এসে ধাক্কা দিল নাকে।
‘খান, বেগ, সমরখন্দের অভিযানে আপনি আরো অনেক বেশী সফল হবেন,’ নীচুস্বরে বলল আলি দোস্ত বেগ।
আহমদ তনবাল মাথা নীচু করে কৃতজ্ঞতা জানালো, তারপর পেয়ালা নিঃশেষ করে দিয়ে সামনে রাখা মাংসের টুকরোর দিকে হাত বাড়ালো।
‘এখন আমাদের মাংসের ভান্ডার ভর্তি, যতদিনে আমরা সমরখন্দ, বুখারা দখল করবো, ততদিন পর্যন্ত চলবে,’ মাতাল আলি দোস্ত বেগ সবাই যাতে শুনতে পায় এমনভাবে জোরে জোরে বলল। ‘শিগ্রি ভিযান আরম্ভ করতে হবে।’
বাবর পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন বেগদের সমরখন্দ অভিযানে যাবার এত ইচ্ছা ধনী হবার জন্য। তাদের প্রবল ইচ্ছার বিরোধীতা করা আগেও কঠিন ছিল আর এখন তা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ী নদীর খরস্রোতের মত, সেই স্রোতকে পিছন দিকে ফেরানোর ক্ষমতা আর কারো নেই এখন।

মওলানা ফজল উদ্দিন কয়েকদিন হল এসে আছেন খরস্রোতা বুবরাইয়ের তীরে, অতি সুন্দর সবুজ মনোরম জায়গায়। ছোট্ট বাড়ীটি আর তার সামনে বারান্দা, যেখানে স্থপতি সাধারণত কাজ করতেন, তার কাছেই কয়েকটি নাসপাতি গাছ। উঠোনের এক কোণে ছাঁচতলায় ঘোড়া বাঁধার জায়গায় দুটি ঘোড়া বাঁধা। চাঁদকপালী, পাটকিলে ঘোড়াটি মির্জা বাবর তাকে উপহার দিয়েছেন।
মওলানা ফজল উদ্দিনকে বাদশাহের ব্যক্তিগত স্থপতি নিযুক্ত করা হয়েছে, বাদশাহের কাছে সম্মান পেয়েছেন তিনি, আনন্দিত হওয়ারই কথা। মির্জা বাবর আর স্থপতি দু’জনে মিলে আগামী বহু বছর ধরে আন্দিজানে মাদ্রাসা, গ্রন’াগার প্রভৃতি নির্মাণের পরিকল্পনা রচনা করেছেন, এ ব্যাপারে মওলানার প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেছেন, আরো বলেছেন যে যতদিন তিনি অভিযানে ব্যস্ত থাকবেন খানজাদা বেগম নির্মাণকাজের তদারক করবেন, তাই প্রতিটি নকশা, খুঁটিনাটি সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা বলে নেওয়া ভাল। যখন মওলানা ভাবলেন বেগমের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সাক্ষাতের কথা, তার হৃদয় ছেয়ে গেল যুগপৎ আতঙ্ক ও সুখের অনুভূতি।
কিন’ গতকাল শোনা গেল যে বাবর নতুন করে সমরখন্দ অভিযানে যাবার তোড়জোড় করছেন আর এই অভিযান চালাতে সর্ব শক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন, এর জন্য প্রয়োজন রাজকোষের সমস্ত অর্থ, নির্মাণ কাজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখা হবে। আর যদি বাবর সমরখন্দ অধিকার করতে না পারেন, আল্লাহ্ না করুন একেবারেই পরাজয় স্বীকার করেন? তাহলে মওলানার সমস্ত স্বপ্ন আপনা থেকেই উবে যাবে। এমন কি বাবর সমরখন্দ দখল করলেও মাভেরন্‌নহরের শাসক হয়ে তিনি সেখানেই থেকে যাবেন। ফরগানা সম্বন্ধে আগেকার মত চিন্তা কি আর করবেন? রাজধানীকেই তো সবচেয়ে বেশী সুন্দর করে তোলায় মন দেওয়া হয়, তখন কি আর আন্দিজান রাজধানী থাকবে? মওলানার সমস্ত কাজকর্ম, পরিকল্পনা এই নশ্বর, ভঙ্গুর জগতে যেন বালির ওপর গড়া প্রাসাদ..
মোল্লা ফজল উদ্দিন বসে বসে একটা জ্যামিতি বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলেন কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই। তার মেজাজ ক্রমশই খারাপ হতে থাকল।
ফটকে ধাক্কা দেয়ার আওয়াজ হল। বুড়ো চাকরটি কাঠের বেলচা দিয়ে ছাঁচতলায় ঘোড়া বাধাঁর জায়গায় ঘোড়ার মল পরিষ্কার করছিল, ফটকের দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর বারান্দার কাছে এসে বলল, ‘মোল্লা, কে যেন ভেতরে আসতে চাইছে।’
‘কে যেনটা আবার কে?’
‘আলুথালু পোশাক পরা কিন’ বোঝা যাচ্ছে বেশ জোয়ান চেহারা, বলছে, আমি ওঁর ভাগনে।…. ওকে ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে বলেছি।’
‘ভাগনে? দাঁড়া তো, দাঁড়া,’ উঠে দাঁড়ালেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, খালি পায়ে চামড়ার জুতো গলিয়ে নিয়ে তিনি আধখোলা ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন।
দীর্ঘদেহী এক যুবক, আলুথালু ধুলোমাখা চোগা আর ক্ষয়ে যাওয়া জুতো পরনে, দাঁড়িয়ে আছে নিস্পন্দ হয়ে। চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। তার চোখের চাউনি এবং মুখের হাসি ভীষণ পরিচিত।
‘মামা,’ বলে লোকটি মোল্লার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
‘তাহের! তাহের জান!’ তাকে জড়িয়ে ধরলেন মওলানা, চেপে ধরলেন বুকে, ‘বেঁচে আছিস। বেঁচে আছিস! মরণের মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে আছিস। হায় রে, তোকে চিনতে পারা দুষ্কর!… এত বদলে গেছিস!… তোর মুখে কি হল রে?’
‘আর জিজ্ঞাসা কোরো না মামা….’
‘আয়, ভিতরে আয়, পরে সব শোনা যাবে…’
সেই দেখার প্রথম মুহূর্তেই মোল্লার সব কথা মনে পড়ল।
না, তিনবছর আগে তাহের মরে নি, আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন। তাগড়াই চেহারা ছেলেটির, সুলতান আহমদের দলবলকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। আর ঐ শয়তানটা- ঐ নামকরা শয়তানটার নোকর, সমরখন্দের প্রাক্তন শাসকের নোকর, নিজের বর্শা দিয়ে তাহেরকে মেরে ফেলেছে ভেবে চলে গিয়েছিল উঠোন ছেড়ে।… বেচারা বোনটি আমার, ভাবলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, ছেলেকে রক্তমাখামাখি অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে সেই যে জ্ঞান হারালো, আর চোখ মেললো না। মামার ডেকে আনা হাকিমদের চিকিৎসায় তিনদিন বাদে জ্ঞান ফিরলো। বর্শার আঘাতে ফুসফুসের ক্ষতি হয়, কিন’ হৃৎপিন্ড ও যকৃতে কিছু হয় নি, তাহেরের অল্প বয়স ও প্রচন্ড শক্তি তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে তোলে ক্রমশঃ। আত্মীয়-প্রতিবেশীরা বলাবলি করতে লাগল যে তাহেরের কাছে মৃত্যু এসেও শেষে নিলো তার মাকে। মোল্লা ফজল উদ্দিন বোনের স্মৃতিতে চল্লিশ দিন শোক পালন করে কুভা ছেড়ে চলে যান- সেই থেকে ভাগনের খবর তিনি আর জানতেন না।
‘তোর আব্বা কেমন আছেন? ভাল?’ তাহেরকে ওপরে উঠতে বলে জিজ্ঞাসা করলেন।
নোংরা পোশাকে পরিষ্কার আসনের ওপর বসতে সংকোচ হলো তাহেরের, একধারে বসল সে।
‘আব্বা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন… আর আমিও মামা, প্রায় বছর ঘুরতে যাই কুভার বাইরে…. আত্মীয়রা এক বুড়ী বিধবাকে এনে দিয়েছে বাবাকে রান্নাবান্না করে দেওয়ার জন্য। আমি… বাড়ীতে থাকতে পারলাম না আর, সব সময় কেবল মা’র কথা মনে পড়ে।’
অবশ্যই একমাত্র মা’র স্মৃতিই তাকে ঘরছাড়া করে নি। হতভাগী রাবেয়া, তার সেই আর্ত চীৎকার কিছুতেই ভুলতে পারে না সে। গতবছরের আগের বছর সে সমরখন্দ পর্যন্ত গিয়েছিল। পথে কাজ করেছে ফসল তোলার, কারাভানের সঙ্গে গিয়েছে, খুঁজেছে তাকে, সর্বত্র জিজ্ঞাসাবাদ করেছে রাবেয়ার সম্বন্ধে, আমার বোনটিকে দেখেছ কেউ? সুলতান আহমদের লোকেরা তাকে নিয়ে গিয়েছে। কিন’ চিহ্নটি নেই তার একেবারে।
ডামাডোলের সময়। সুলতান আহমদ যে বছর ফরগানা আক্রমণ করেন সেই বছরই মারা যান। তার মৃত্যুর পরে সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, সিংহাসন দখল করে প্রথমে তার ভাই সুলতান মাহমুদ, তারপর তার ছেলে বাইসুনকুর। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে হাতিয়ার উঠিয়েছে, ছেলে বাবার বিরুদ্ধে। একজন লোক তাহেরকে বলে অনেক বন্দিনীকে নাকি তাশখন্দের বাজারে বিক্রী করা হয়। গতবছর সে পায়ে হেটে তাশখন্দ পৌঁছায়, খাওয়া জোটে নি ভাল, পোশাক ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। সেখানেও রাবেয়াকে পায় নি। ঘোলাটে নদীর মত বয়ে চলেছে জীবনটা। বৃথাই যে খুঁজে বেড়াচ্ছে তা বুঝতে পারে তাহের- ঘোলা নদীর জলে মুক্তো খুঁজে বেড়ান যেন- কিন’ খোঁজা বন্ধ করতে পারে না।
‘ভাগনা রে, তুই যে তিন বছর ধরে বেচারী মেয়েটাকে খুঁজে চলেছিস, তা তোর উদার মনেরই পরিচয়। বিশ্বস্ততা পুরুষমানুষের উপযুক্ত গুণ। কিন’ আন্দাজে হাতড়ে বেড়ানো মানেও তো নিজের ক্ষতি করা। তাছাড়া ভেবে দেখ, ওর ভাগ্যই এমনি ছিল। কপালের লিখন কে খন্ডায়? যদি বেঁচে থাকে.. তো কেউ তাকে বিয়ে করেছে। হয়তো সন্তানও হয়েছে তার। তিন বছর ধরে তো আর কুমারী রেখে দেবে না তাকে? নিজেই ভেবে দেখ।’
‘একথা আমি অনেকদিনই ভেবেছি মামা… আমি কেবল তার সামনে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই… আর কিছুই না….’
‘কোন পাপ?’
রাবেয়াকে ওর বাবা-মা আন্দিজান পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, আমিই বলে রাজী করেছিলাম কুভাতে থেকে যাবার জন্য।
‘তখন তুই জানবি কি করে যে এমন ঘটনা ঘটবে?’
‘জানতান না ঠিকই… কিন’ যতদিন আমি তাকে খুঁজে না পাব, তাকে দেখতে না পাব, আমার শানি- আসবে না কিছুতেই। যদি আপনি যেমন বলছেন, রাবেয়ার বিয়ে হয়ে থাকে, নিজের ঘরসংসার হয়ে থাকে তো… আমি আমার ভাগ্য মেনে নেব। আর যদি না হয়? যদি তার সম্মানের পারিবারিক জীবন না থাকে… আর এখন তার উদ্ধারকর্তার অপেক্ষায়- আমার অপেক্ষায় থাকে? ওকে তো ভুলতে পারছি না এখনও? ও-ও যদি আমাকে ভুলতে না পেরে থাকে?’
সহানুভূতিতে মাথা নাড়ালেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, ‘তিন বছর কাটলো, তিন বছর… আমাদের প্রত্যেকে, প্রত্যেকেই বদলে গেছে। আগের যে মনোকষ্ট তার কোন ঔষধ নেই, দেখছি।’ বলে কথা ঘোরালেন এবার অন্য দিকে।
‘তাহেরজান, তোর মামা এখন ধনী হয়ে উঠেছে,’ মোল্লা ফজলুদ্দিন জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ফুৎনা ঝোলান কালো চামড়ার একটা ছোট থলি বের করে আনলেন। প্রথমে তিনি কয়েকটি সোনার মোহর তাকে দেবেন ভাবলেন, তারপর পুরো থলিটাই এগিয়ে ধরলেন ওর দিকে। ‘এই নে, আজ জুম্মাবার, বাজারের দিন, অনেক কিছু আসবে, তোর যা দরকার কিনবি।’
‘না মামা, অমনি না… আপনি আমাকে ধার দিন।’
‘ঠিক আছে, বেশ ধারই সই! যা দরকার নিবি, যখন তোর টাকাপয়সা হবে ফিরিয়ে দিস। এ হল অন্য কথা।’
সন্ধ্যার মুখে ফিরল তাহের। সৈন্যরা যে জুতো পরে পায়ে সেই জুতো কিনেছে চমৎকার এক জোড়া, মাথার মোগলটুপী আর মোটা পশমের চেকমেন। তাহেরের হাতে তলোয়ার, সেটার খাপটা রঙচটা- দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন সৈন্যর ব্যবহার করা। বিস্মিত হলেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, ‘তলোয়ার কী হবে তোর?’
‘বাবরের ফৌজে স্বেচ্ছাসেবীদের নাম লেখানো হচ্ছে…’
এবার স্থপতি বুঝলেন ভাগনা ওশে এসেছে কেন, আঁতকে উঠলেন, ‘পাগল হলি নাকি? তাহের, সবাই যুদ্ধ থেকে দূরে পালায়, আর তুই কিনা নিজে বিপদের মুখে মাথা গলিয়ে দিচ্ছিস! সমরখন্দের বর্শা চোটও যথেষ্ট হয় নি তোর?’
‘মামা, সে ঘটনার পরে কতবার মারার মুখ থেকে ফিরে এসেছি। তাশখন্দে এক বেগ এক গরীবলোকের মেয়েকে জোরজবরদসি- ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল- ঠিক যেমন রাবেয়ার ভাগ্যে হয়, আমি থাকতে না পেরে, ঝাঁপিয়ে পড়লাম আর এই-মুখের কাটাদাগ আমার, এ সেই বেগের ছোরার দাগ…’
‘এখনও বুঝিস নি যে শক্তিরই জয় দুনিয়াতে?’
‘তাই আমি শক্তিশালী সৈন্যদলে নাম লেখাতে চাই। অত্যাচারীরা শক্তিকে ভয় পায়।… মানুষের অনেক কষ্ট দেখেছি, মামা সাধারণ লোকের সঙ্গে দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি আমি। অনেকে আমায় বলেছে যে মির্জা বাবরের মনটা পরিষ্কার, সৎ চিন্তাধারা।… ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্ ছাড়া আর কে আমাদের সাহায্য করতে পারে?’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মোল্লা ফজল উদ্দিন, ‘কিন’ মির্জা বাবরের বয়স অত্যস্ত কম। আমিও তার ওপর আশা করেছিলাম ভেবেছিলাম, ফরগানাকে সুন্দর করে তুলব… আবার যুদ্ধ আবার রক্ত… সবাই আমরা অন্ধকারের মধ্যে আছি, অন্ধকার রাত্রির আলিঙ্গনে। এই সময় ন্যায় বোধহীন, ধূর্ত। দেখিস, তোকেও যেন জালিম বেগদের হাতের অস্ত্রে পরিণত না হতে হয়।’
‘আমাকে বিশ্বাস করুন মামা, তা হবে না, অন্যায়ের পথে থাকব না আমি….’
‘বাবর নিজে বেগদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, প্রশ্রয় দিচ্ছেন অন্যায়কে।’
‘তার কারণ হয়ত আমার মত লোকের সংখ্যা মির্জা বাবরের দলে খুব কম? বেগদের দলবল নিয়েই ফৌজ তৈরী হয়। বহুদিন ধরেই তা চলে আসছে।… আমি আর কোন পথ পেলাম না খুঁজে মামা। একা একা আমি কিছুই করে উঠতে পারব না।’
মোল্লা ফজল উদ্দিন একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন ভাগনার দিকে। যা সি’র করেছে ও, তার থেকে পিছু হঠান যাবে না ওকে, না কিছুতেই না।
‘যে নাম লেখাচ্ছে তার সঙ্গে কথা বলেছিস তুই?’
‘হ্যাঁ। সে বলল, তোর ঘোড়া নেই, পদাতিক দলে নেব তোকে। আমার তো পায়ে হেঁটে হেঁটে অভ্যাস হয়ে গেছে মামা।’
‘সব থেকে বেশী ক্ষতিস্বীকার করে পদাতিক বাহিনী, তুই ভেবে দেখেছিস একথা?’
‘তাতে কী… এক যুদ্ধ বা চল্লিশটা যুদ্ধ… যার মরার কথা সে মরবেই।’
‘যুদ্ধ, মৃত্যু ওসব কথা এখন থাক, ভাগনে।’
সকালে নাস্তা খাওয়ার পর মোল্লা ভৃত্যকে আদেশ দিলেন ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে থাকা দুটি ঘোড়াকেই লাগাম-জিন পরাতে।
‘ঐ ঘোড়াটা নে,’ লম্বা পা ঘোড়াটা দেখিয়ে তাহিরকে বললেন, ‘তুই পদাতিক দলে গেলে আমার মানে লাগবে।’
স্থপতি নিজে বসলেন বাবরের উপহার দেওয়া পাটকিলে রংয়ের চাঁদকপালী ঘোড়াটায়। দু’জনে মিলে বাবরের মহলের দিকে চললেন। মোল্লা ফজল উদ্দিন কাসিম বেগকে অনুরোধ করলেন তাহেরের জন্য।
‘বাদশাহ্‌কে অনুরোধ করতে চাই, আমার ভাগনেকে তিনি যদি…. তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদলে নেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ও মির্জা বাবরের বিশ্বস্ত যোদ্ধা হয়ে থাকবে।’
কাসিম বেগ দেখল কি মজবুত, শক্তিমান চেহারা তাহেরের।
‘এর আগে সৈন্যদলে ছিলি কখনও?’ তাহেরের মুখের ক্ষতচিহ্নটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল কাসিম বেগ।
‘না, ছিলাম না কখনও, তাহেরের উত্তরটা অত্যন্ত শুষ্ক, অনমনীয় শোনাল।
মোল্লা ফজল উদ্দিন যোগ দিলেন, ‘জনাব আমীর উল-উমরা, আমার ভাগনেটা চাষী পরিবারের ছেলে, কিন’ সিপাহী হতে গেলে যে সব গুণ থাকা দরকার সে সবই ওর আছে। শক্তি, সাহস আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। মনে আছে আপনার কুভা নদীর পুলের ওপর সমরখন্দ সৈন্যদলের কি দারুণ ক্ষতি হয়? তখন আমাদের বিজয় এনেছিল যারা তাদেরই একজন এই তাহের…’
‘আমাদের বিজয় এনেছিলো?’ অবিশ্বাসের ভঙ্গীতে জিজ্ঞাসা করলো কাসিম বেগ, ‘কেমন করে?’
স্থপতির সংক্ষেপে বলা কাহিনীতে মনে হলো যেন গ্রামের সাধারণ কয়েকটি ছেলে এমন কাজ করেছে, যা বেগ বা যোদ্ধারা করতে পারে নি। কাসিম বেগের সেকথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হলো না।
‘কুভার জয় খোদার দান, মওলানা।’
‘অবশ্যই, খোদা নিজে এই ছেলেগুলির মনে সরু পুলটা ধ্বংস করে ফেলার কথা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।…. তখন তাহের গুরুতর আঘাত পায়, মরতে মরতে বেঁচে যায়, জনাব কাসিম বেগ। ‘তাই নাকি!’ এবার খানিকটা প্রসন্ন মনে উজীর তাকাল তাহেরের দিকে। ‘সমরখন্দের লোকেদের ওপর তোমার যেন কোন পুরানো হিসাব চুকানোর ইচ্ছে আছে, নওজোয়ান?’
‘জ্বি হ্যা, হুজুর।’
যে লোকটা নাম লিখে নিচ্ছিলো, কাসিম বেগ তাকে বললো, ‘চিলমহরম পাহাড়ের নীচে যাদের তালিম দেওয়া হচ্ছে সেই সিপাহীদের দলে এই ছেলেটির নাম লিখে নাও। তারপর মোল্লা ফজল উদ্দিনকে বুঝিয়ে দিল, সব থেকে ভালদের বেছে নেওয়া হয়েছে ঐ দলে। এদেরই বাদশাহের দেহরক্ষীদলে নেওয়া হবে।

বেগদের বৈঠকে সমরখন্দ অভিযান রমজান মাসে শুরু করা হবে বলে সি’র হল। প্রধান প্রস্থতির প্রায় সবটাই ওশে করা হবে। বাবর চেষ্টা করছেন কুতলুগ নিগর-খানমের সামনে না পড়ার। অভিযানের পর্বের দায়িত্ব থেকে মুক্ত সময় কাটান নিজের তাবুতে একা। বইপুথি পড়েন।
আজ সন্ধ্যায় নামাজের পরে বাবার তার ‘অতীত কথা’তে লিখেছেন পিতার মৃত্যুর কথা। ভৃত্য এসে খবর দিলো কুতলুগ নিগর-খানম আর আলি দোস্ত বেগ তার সঙ্গে দেখা করতে চান। খাতা বন্ধ করে বাবর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে, তাকে এনে সম্মানের আসনে বসালেন।
কুতলুগ নিগর-খানমের চেহারা মলিন। কপালের একটু ওপরে, ঠিক সিঁথির কাছে এক গোছা সাদা চুল চোখে পড়ছে। বয়স তার মাত্র চল্লিশ বছর, পোশাক পরেন বৃদ্ধার মত, ঝুঁকে পড়ে হাটাচলা করেন। বাবরের মায়া হল মায়ের জন্য, নীচু শান্তস্বরে তিনি নিজেই সেকথা আরম্ভ করলেন যা কয়েক মুহূর্ত আগে মোটেই বলতে চান নি, ‘আম্মাজান, আপনি ভাববেন না যে আমি আপনার সব উপদেশ ভুলে গিয়েছি। খোদা যদি তেমনি দিন দেন তবে সমরখন্দ অভিযান থেকে ফিরে এসে তারপর আপনি যা যা বলেছিলেন সব করব আমি।’
‘আল্লাহ্ সর্বশক্তিমান সবকিছু দেখতে পান তিনি। আমার তার দাস মাত্র- কোন কিছু নিয়ে রাগ করা উচিত নয় আমাদের! খোদার রহম্ থাক তোমার ওপর, আমার বাছা মীর্জা, তোমার মনের ভাল ইচ্ছা যেন পূরণ হয়!’
‘আমিন’, দোস্ত বেগ তার শক্তিশালী হাতগুলি ওপরে ওঠাল দোয়া করার ভঙ্গীতে, ‘ইলাহি আমিন!’ নিজের মোলায়েম মাকুন্দ মুখের ওপর বুলিয়ে নিলো।
এই মাকুন্দ লোকটি বাবরের নানী এহসান দৌলত বেগমের চাচাতো ভাই। সেই কারণে বেশ জাঁক করে নিজের নামের আগে খেতাবের মত করে যোগ করে ‘আগোই’ (অর্থাৎ বাদশাহের মামা) এবং সেই কারণেই কুতলুগ নিগর-খানমের প্রতি তার অভিভাবকসুলভ মনোভাব। আর তাই সবাই রেশমী আসনের ওপর বসলে আলি দোস্ত বেগ কুতলুগ নিগর-খানমের দিকে তাকালো, চোখে কিছুটা অনুপ্রেরণা দেওয়ার মত ভঙ্গী আর জিজ্ঞাসা যেন বলতে চাইছে আরম্ভ করা যাক, তাহলে? খানম মাথা নাড়ালেন কিছুটা সম্মতি জানিয়ে আর কিছুটা আলি দোস্ত বেগকে কথা আরম্ভ করার অধিকার দিয়ে। আলি দোস্ত বেগ একটু কেশে নিয়ে, মাথা নীচু করে বলতে আরম্ভ করল, ‘হুজুরে আলী, আপনার ওয়ালিদা সাহেবা আর বিশ্বস্ত মামা আপনার কাছে এসেছেন এক অতি সূক্ষ্ম সমস্যার বিষয়ে পরামর্শ করতে। আপনার মাননীয়া ভগিনী খানজাদা বেগমের বিশ বছর পূর্ণ হল। এবার বিবাহের প্রয়োজন। সে চাঁদের মতই সুন্দর, দিনের মতোই পরিষ্কার , বুদ্ধিমতী ও বিনয়ী, কিসের মতো বলি…. জানি না কিসের মতো, যাক এটা আসল কথা নয়। আসল কথা হল এখন পর্যন্ত তার উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যায় নি। আপনার ওয়ালিদা সাহেবা ও মামা চিন্তায় পড়েছেন: এমন উপযুক্ত সময় চলে যাচ্ছে…’
‘আরো দু’এক বছর বসে থাকলে তো ওকে নিয়ে হাসাহাসি আরম্ভ হয়ে যাবে। লোকে বলবে মির্জা ওমর শেখের মেয়ে আইবুড়োই রয়ে গেল,’ কুতলুগ নিগর-খানম বললেন।
‘কে আমার বোনকে শাদী করতে চায়?’
আলি দোস্ত বেগ এমনি সোজাসুজি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইল না।
‘কে একথা বলতে সাহস করবে যে আমি ফরগানার বাদশাহের বোনাই হবার উপযুক্ত?’ বৃদ্ধ বেগ সাড়ম্বরে জবাব দিল।
‘তবু?’ আবার জোর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন বাবর।
‘হুজুরে আলী, আপনার সিপাহীসালারদের মধ্যে আছে সুলতান আহমদ তনবাল। বড় বংশ, সাহসী, যোদ্ধা, আঠাশ বছর বয়স। গতবছর কেমন করে ও ইয়াকুব বেগের ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে সাহায্য করে মনে আছে আপনার? আর চাগ্রাকদের বিরুদ্ধে অভিযান?’
বাবর ঘাড় নেড়ে জানালেন মনে আছে। কিন’ যখন তিনি খানজাদা বেগমকে আহমদ তনবালের পাশে কল্পনা করলেন বুকটা তার ব্যথায় টনটন করে উঠল- কোনো মিল, মনের কোনো মিলই নেই।
‘আম্মাজানের কি মত আছে?’
কুতলুগ নিগর-খানম গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘আর কি উপায়ই বা আছে?’ প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করলেন তিনি। ‘রাজাবাদশার উপযুক্ত খানজাদা। কিন’ এই গোলযোগের সময়ে ভাল পাত্র কোথায় পাব? তোমার মামা আর আমি খোঁজখবর করে জেনেছি, বেগ আহমদ তনবাল অত্যন্ত খানদানী ঘরের সন্তান, তার প্রপিতামহ ছিলেন সুলতান, স্বয়ং চেঙ্গিজ খানের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ছিল। তার বড় ভাই বেগ তিলবা বর্তমানে তাশখন্দে- তোমার মামা খান মাহ্‌মুদের উজীর আজম। যদি বেগ আহমদ আমাদের জামাতা হন তো নিজের বড় ভাইয়ের সাহায্যে তিনি তোমার মামা খান মাহ্‌মুদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করবেন। তাছাড়া এমনিতেও এমন প্রতিপত্তিশালী বেগ তার আত্মীয়পরিজন সৈন্য সামন্ত সমেত তোমার পক্ষতলে, এ এক বিরাট অবলম্বন।’
‘ঠিক কথা!’ গভীর বিশ্বাসে বলে উঠল আলি দোস্ত বেগ।
বাবর কাঁধ ঝাঁকালেন, কী বলবেন বুঝতে পারলেন না, এমনকি সঙ্কোচ হলো তার- বোন তার থেকে পাঁচ বছরের বড়, এদিকে মা আর বৃদ্ধ বেগ তাকে এমনি গুরুতর ব্যাপারে সিন্ধান্ত নিতে বলছেন?
‘বেগমের নিজেরও ভালই হবে এ বিবাহে,’ বলে চলল দোস্ত বেগ, ‘কোন বাদশাহের সঙ্গে শাদী হলে, মায়ের কাছ থেকে দূরে চলে যেতে হবে, চলে যেতে হবে তার প্রাণপ্রিয় ভাই আমাদের বাদশাহের আশ্রয় ছেড়ে….’
‘ও কাছে থাকলে আমারও বেশ ভাল হবে,’ আবার তাকে থামিয়ে দিলেন কুতলুগ নিগর-খানম, ‘খানজাদা আমার প্রথমা কন্যা, আমার পরামর্শদাতা, এখানে বিয়ে হলে আমার চোখে চোখেই থাকবে, একা বোধ করব না আমি।’
বাবর ভাবলেন অনেক কিছু যা তার মাথায় আসে না তা মা জানেন। দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আম্মাজানের যখন মত আছে, তখন সব মিটে গেল।’
‘দোস্ত বেগ খুশী হয়ে উঠল, ‘ঠিক তাই, হুজুর, ঠিক তাই। কথায় বলে, মা রাজী তো খোদাও রাজী!’
কুতলুগ নিগর-খানম কিন’ আনন্দিত নন।
‘কেন?’ বাবর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর বেগম নিজে কি বলছেন?’
কুতলুগ নিগর-খানম অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললেন, ‘তার মনখারাপের কারণ, বেগম রাজী নয়। যখন জানতে পারল, অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল।’
‘এমন সময় সব মেয়েই কাঁদে,’ হি হি করে হেসে বলর দোস্ত বেগ।
‘থামুন বেগ,’ হঠাৎ বিরক্ত হয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন কুতলুগ নিগর-খানম, ‘থামুন…. খানজাদা বেগমের মানসিক অবস্থা আমাকে অত্যন্ত চিনি-ত করে তুলছে। বাবরজান,’ এবার চাপা স্বরে তিনি বললেন, ‘আমি হঠাৎ শুনে ফেলি তার ভয়ঙ্কর কথাগুলি… সে আত্মহত্যা করতে চায়…. কী যে করি, কী যে করি বুঝতে পারছি না….’
‘কী?’ লাফিয়ে উঠলেন বাবর।
বৃদ্ধ বেগ কিন’ চুপ করে রইল না, ‘হুজুরে আলী, আপনার বোন আপনাকে প্রাণের চেয়ে ভালবাসেন,’ বলল সে, ‘আপনার অনুরোধ তিনি প্রত্যাথ্যান করবেন না। আপনার অনুরোধ নিয়ে যে আপনি খানজাদা বেগমকে কাছে ডেকে কথা বলুন। রাজ্যের স্বার্থে আপনার বোনকে সম্মতি দিতেই হবে। আলী নসব বেগ আহমদ অনুগ্রহের অপেক্ষায় আছেন। আপনি মালিকা সাহেবাও ঠিক কথাই বলেছেন- আরও তিন চার বছর বেগম ঘরে বসে থাকলে আপনার শত্রুরা গুজব ছড়াবে যে এই আইবুড়ো বেগমের জন্য পাত্র খুঁজে পেল না। এই গুজবে আপনার পরিবারের ক্ষতি হবে। খানজাদা বেগম যদি আপনার মঙ্গল চান তো রাজী হতে হবে তাকে। হতেই হবে….’
বাবর দু’হাতে মাথা চেপে ধরে দিশাহারা হয়ে চুপ করে রইলেন। এমন ঘটনার সম্মুখীন হওয়া তার জীবনে এই প্রথম। অন্য কেউ হলেও বা কথা ছিল। … নিজের মায়ের পেটের বোন! তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা আরম্ভ করতেও অস্বসি- লাগছে বাবরের।… একদিকে মা তার সাহায্যের অপেক্ষায় আছেন… সাহায্য চাইছেন, আবার ওদিকে তার বোন নিজের জীবনটা শেষ করে দিতে চলেছে- কী দারুণ পাপই না হবে তাহলে।
‘ঠিক আছে,’ নিজের জন্য কোন কিছু সিদ্ধান্ত না নিয়েই বললেন বাবর শেষে, ‘বেগম আসুক একবার আমার কাছে, একা ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।’
খানম তাড়াতাড়ি জায়গা ছেড়ে উঠলেন, ‘এখুনি… ওকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি।’
ফোকলা মুখে ফাঁক করে মৃদু হাসল দোস্ত বেগ, ‘হুজুরে আলী, আপনার সিদ্ধান্ত সকলের কাছে আইন!’ বলে মুখ পাথরের মত শক্ত করলেন, যেন বাবরকে দৃঢ় হবার ইঙ্গিত দিলেন।
তারা দু’জন এখন একা। বাবর ছোট ছ’পায়া মেজ্-এর ওপর একটা বই রেখে আসে- আসে- পাতা উলটাচ্ছেন, প্রদীপদানের দুটি প্রদীপের আলো যে তার বই পর্যন্ত এসে পড়ছে না তা লক্ষ্য করছেন না। খানজাদা বেগমের পরনে একরঙা হলুদ পোশাক, বসে আছেন তিনি, মুখচোখে রোগার্ত পান্ডুর ভাব।
‘আপনার কী হয়েছে, আপাজান?’ বাবর বলতে যাচ্ছিলেন।
‘হুজুরে আলী, আপনার সাহায্যের প্রত্যাশায় আছি আমি।’
খানজাদার বিষন্ন মুখমন্ডল বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল, কিন’ গলার স্বর দৃঢ় শোনাল। আবার বাবর অনুভব করলেন, বুকটা ব্যথা করে উঠল। মেয়েরা কাঁদলে থাকতে পারেন না তিনি। ভাগ্য তার মাথার ওপর এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয় নি? বাবর আন্তরিক দুঃখ নিয়ে বললেন, ‘আমার নিজেরই সাহায্যের প্রয়োজন, যে পরিসি’তিতে আমি পড়েছি, আমি নিজেই তার থেকে বেরোবার পথ খুজছি। একটার পর একটা কঠিন কাজের ভার এসে চাপছে মাথায়। আপনি চোখের জল দিয়ে আমাকে কোণঠাসা করে ফেলতে চাইছেন?’
দ্রুত আত্মসংবরণ করবার চেষ্টা করলেন খানজাদা, ‘শাহজাদা, আমি শুনেছি যে…. আহমদ তনবাল পাহাড়ে মারা রাখালদের মাথাগুলো কেটে নেয়, বয়ে আনে একগাদা কাটামাথা…’
বাবরের মনে পড়ল গোঁফদাড়ি না গজান রক্তমাখা মানুষের মাথাটা, কেঁপে উঠলেন তিনি।
‘খুনজখম ছাড়া যুদ্ধ হয় না,’ বোনের চেয়ে নিজেকেই বেশী বোঝাতে চাইলেন। ‘আমাদের সিপাহীরাও তো মারা গেছে।’
‘আমি আমার এই সামান্য জীবন কোন আলোকপ্রাপ্ত লোকের সঙ্গে কাটাবার স্বপ্ন দেখতাম। আহমদ তনবালের হাত রক্তমাখা, ও খুনী। শাহজাদা, আপনি কি ওকে আমার যোগ্য মনে করেন?’
‘আপনার উপযুক্ত পুরুষমানুষ হয়ত সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। কিন’ ওয়ালিদা সাহেবাও বোধহয় আপনাকে… কারণগুলোর কথা কিছু বলেছেন… আর আমিও… আপনাকে অনুরোধ করতে বাধ্য।’
খানজাদা বেগম জ্বলন্ত মোমবাতির স্বল্প আগুনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কল্পনা করলেন আহমদ তনবালকে, তার কদর্য চেহারা, মাকুন্দ মুখ, ভাবলেন তার সঙ্গে একবিছানায় শুতে হবে- ঘৃণায় সারা শরীরটা কেঁপে উঠল তার, ‘আমি ঐ বেগকে ভয় পাই।’
‘ভয় পাবার কিছু নেই বেগম। কাউকে আপনার এক কণা ক্ষতিও করতে দেব না আমি।’
‘কিন’ আপনার বোনকে জোর করে বিয়ে দেয়া হচ্ছে এমন একজন.. ঘৃণ্য লোকের সঙ্গে- এর থেকে বড় অপূরণীয় ক্ষতি কী হতে পারে?’ বাবরের দৃঢ়তা শিথিল হয়ে যেতে লাগল ক্রমে।
‘মন্দ… ভাগ্যই মন্দ! আমি সারা দিন এমন সব লোকের মধ্যে যাদের পছন্দ করি না। আমাকে দিয়ে সেই সব কাজ করায়, যা আমি করতে চাই না। কিন’ আমাদের রাজ্যের কথা, মাভেরান্‌নহরের কথা ভেবে নিজেকে বাধ্য করি যে সব করতে।’
দু’জনে যেন পরস্পরের কথা না শুনে যে যার নিজের কথা বলে যাচ্ছে- যদিও খানজাদা বেগম ভাইকে বেশী ভাল করে বুঝতে পারেন, সহানুভূতি বোধ করছেন তার জন্য। হঠাৎ তার মনে পড়ল ভাইটি যখন খুব ছোট্ট ছিল কী আদরে তাকে কোলে করতেন তিনি।
‘বাবরজান, আমার একমাত্র ভাই, একমাত্র রক্ষক, আপনার জন্য জীবন দিতেও পিছপা হব না আমি। আপনার খাতিরে আহমদ তনবালকে বিয়ে করতেও রাজী হতাম হয়ত আমি। কিন’ আপনার সংবেদনশীল মনের কথা খুব ভাল করেই জানি আমি, যেহেতু আমি সারা জীবন অসুখী থাকব, আপনার হৃদয় বেশী কষ্ট পাবে আমার দুঃখে, আমার নিজের হৃদয়ের থেকেও বেশী।’
‘কিন’ আমি খোদার কাছে দোয়া জানাব। আমার ধারণা, আপনি অসুখী হবেন না।’
‘যদি আমি এই লোকটি শাদী করি তাহলে সারা জীবন কষ্ট পাব আমি, বিশ্বাস করুন বাবরজান! আর মাভেরান্‌নহরের স্বার্থের কথা যদি বলেন… বাদশাহ্ও মানুষ, তিনিও বেঁচে থাকেন মাত্র একবার।…. আমাদের হৃদয় কি বলে তা মন দিয়ে শোনা উচিত আমাদের! পরিচ্ছন্ন মন মানুষকে মন মানুষকে কখনও প্রতারণা করবে না।’
খানজাদা বেগম এমন আন্তরিক আবেগের দমকে বলে যাচ্ছিলেন যে তার হৃদয়ের আগুনের ছোঁয়া লাগল বাবরের মনেও। নিষ্ঠুর বেগের দল, রাজ্যের দায়দায়িত্ব, ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা, এ সব কিছ যেন শীতে জমা বরফের মতই। খানজাদা বেগম যেন সেই বরফ গলিয়ে দিচ্ছিলেন, বাবরের হৃদয় যেন গলে যাচ্ছিল। আবার তার মধ্যে ফিরে এলো বসনে-র উষ্ণতা, তরুণবয়সের স্বাধীনতা- স্বসি-তে হালকা হয়ে গেল তার বুকটা।
খানজাদা কথা বলছেন আর তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে।
বাবরজান আপনার মনটা পরিষ্কার, আপনি প্রতিভাবান, আত্মত্যাগী তরুণ!… এই বেগরা নিজেদের স্বার্থকে রাজ্যের স্বার্থ বলতে শিখেছে। ওরা আপনার অল্পবয়সের সুযোগ নিচ্ছে। কিন’ যখন ওরা আপনাকে অপ্রিয় কোন কাজ করার জন্য চাপ দেবে তখন, আমার আর্জি, নিজের মন কী বলে কান পেতে শুনুন। আপনার পরিষ্কার মনই হল সব থেকে ভাল উপদেষ্টা। নিজের মন কখনও আপনাকে প্রতারণা করবে না।’
খানজাদা বেগম ভাইয়ের দিকে দু’হাতে বাড়িয়ে দিলেন, শাহজাদা, আমি আপনার পরিষ্কার মনের কাছে ন্যায়ভিক্ষা করছি। আপনার মন আপনাকে যা বলে আপনি আমাকে সেই আদেশ দেবেন। আমি তা মেনে দেব।’
বাবর আসন থেকে লাফিয়ে উঠে বোনের হাত ধরে তুলে দাঁড় করালেন তাকে।
‘আর কাঁদবেন না, এবার চুপ করুন।’ ফিসফিস করে বললেন তিনি। কোন রকমে নিজেকে সামলে রেখেছেন তিনি কেঁদে যাতে না ফেলেন। ‘আমার একমাত্র, মায়ের পেটের বোন আমার কাছে সব বেগের থেকেও আপন! এই বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মত বিপদই আসুক না কেন, সে সবের দায়িত্ব আমি নিলাম। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন আমার বোনের বিয়ে তার ভাল না লাগা লোকের সঙ্গে হতে পরবে না কিছুতেই।

Leave a Reply