আন্দিজান
১
আন্দিজানে এখনও সবকিছু শান্ত।
শহরের বাইরে উঁচু দেওয়ালের আড়ালে বারো বছর বয়সী বাবর (বাবর অর্থ সিংহ) মির্জা মত্ত হয়ে যুদ্ধবিদ্যা শিখছে। মাঠের ওপর দিয়ে জোর ছুটছে তার ঘোড়া, এবারে লাগাম ছেড়ে দিয়ে ধনুকের ছিলায় টান দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে তীর ছুঁড়ল, ফাঁপা একটা আওয়াজ তুলে তীর গিয়ে বিঁধল চাঁদমারি হিসাবে ব্যবহৃত কাঠের তক্তাটায়।
একদল ঘোড়সওয়ার চিনারগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর যুদ্ধবিদ্যাচর্চার ওপর লক্ষ্য রাখছে। কালো ঘোড়ার ওপর বসে মজিদ বেগ প্রথম এগিয়ে গেলেন চাঁদমারির দিকে। তিনি হলেন মির্জা বাবরের শিক্ষাগুরু। যখন বাবর নিজের জায়গায় ফিরে এলেন ওস্তাদ তার দিকে ফিরে বললেন আবেগহীনভাবে, ‘নিশানা ছিল ওপরদিকে।’ তরুণ হতাশ হয়ে গেছে দেখে আবার বললেন, ‘একটু ওপরদিকে ছিলো, কিন’ তীরছোঁড়া চমৎকার হয়েছে।’ কাঠের তক্তা থেকে তীরটা টেনে বার করে মজিদ বেগ আঙুল দিয়ে মাপলেন কাঠের কতটা গভীরে তীরটা গিয়ে ঢুকেছে, বাবরকে দেখালেন, ‘আপনার হাতে বেশ শক্তি দেখছি, শাহজাদা! সিংহের থাবা! আমাদের শাহ্ আপনার নাম বাবর অকারণে দেন নি।’
মির্জা বাবরের সহচরেরা, অস্ত্রবাহী খেদমতগার আর খেলার সঙ্গীরা- সবাই তার সমবয়সী- এসে জড়ো হয়েছে চাঁদমারির কাছে। তারা জানত যে বাবরের বয়স এবং উচ্চতা অনুযায়ী তার ধনুক নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সবাই অবশ্য প্রশংসা করতে লাগল। বাবরও কিন’ এসব কথা জানতেন, ‘সিংহের থাবার জোর আমার আব্বার হাতে। নিজের চোখেই দেখেছি তার তীর আমার তীরের চেয়ে দশগুণ বেশী শক্তিতে গিয়ে লাগে। তিনি একটা ঘুষি চালালে কোন শক্তিমান পুরুষই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।’
‘আপনার হুকুমবরদার সেকথাই বলতে চাচ্ছে যে আপনার সিংহের মত শক্তি এই কারণেই যে আপনি ঠিক আপনার পিতার মতই!’ সুকৌশলে কথার মোড় ঘোরালেন মজিদ বেগ।
একটু মুচকি হাসলো বাবর। কোন কথা না বলে চওড়া, হলুদের ছোঁয়ালাগা রোদেপোড়া কপাল আর ওপরের ঠোঁটের কাছ থেকে ঘাম মুছলেন।
গরম বাড়ছে, শাহ্জাদা। রমজানের রোজার সময় শরীর বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ইফতারীর আগেই শক্তি ক্ষয় করে ফেললে চলবে না। ছায়ায় বিশ্রাম নেয়া দরকার একটু। আপনার হুকুম বরদার এখন বিদায় নেবে আপনার কাছে- আন্দিজানের প্রতিরক্ষার প্রস্থতি কাজ দেখা দরকার।
কিন’ বিশ্রাম নিতে ভাল লাগে না বাবরের। তার ইচ্ছে ছুটোছুটি, দুষ্টমি করতে। যেই মাজিদ বেগ চলে গেলেন, দুষ্টুমিতে তার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। ঘোড়া থামিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে বাবর একজন সহচরকে কাছে ডাকলো। যখন সহচরটি কাছে এলো বাবর হাত বাড়িয়ে তার চাঁদকপালী বাদামী রংয়ের ঘোড়াটির পিঠের জিন পরীক্ষা করে দেখলো, শক্ত করে বাঁধা আছে।
তখন বাবর তাকে আদেশ দিলেন পঞ্চাশ পা দূরে চলে গিয়ে, ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়ার লাগাম ধরে তাকে পেরিয়ে চলে যেতে।
বাবরের সহচর বন্ধুর দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী ছিল ষোল বছর বয়সী নুয়ান কুকলদাস। সে আর বাবরের বোন এক মায়ের দুধ খেয়েই বড় হয়েছে। বাবর কী করতে চাচ্ছে তা আন্দাজ করে দুশ্চিন্তায় পড়ল সে, ‘শাহজাদা, এখুনি আপনার অনুশীলনী শেষ হল। যথেষ্ট হয়নি কি? অন্যান্য কঠিন অনুশীলনী কালকের জন্য থাক না?’
‘তাই হবে। কঠিন অনুশীলন আগামীকালের জন্য থাক। আজ সহজ অনুশীলন করা যাক।’
হেসে উঠলো বাবর। নিজের ঘোড়াটাকে উত্তেজিত করে তুললো। ঘোড়াটা কদমতালে ছুটতে লাগলো, সমানতালে চলতে থাকা অনুচরটিকে ধরে ফেললো, পা ছাড়িয়ে নিলো রেকাব থেকে, চাবুকটা দাঁতে কামড়ে ধরে যেই তার ধূসর ঘোড়াটা বাদামী ঘোড়ার পাশে এলো অমনি হাত বাড়িয়ে বাদামী ঘোড়ার পিঠের জিনটা দুহাতে জাপটে ধরে নিজের জিন থেকে লাফিয়ে উঠলো। অনুচরটির ঘোড়া ভয় পেয়ে এক লাফে পাশে সরে গেল। এক মুহূর্ত ঝুলে রইলো বাবর, পা দুটো দারুণ জোরে ঠুকে গেল মাটিতে। কিন’ জিনধরা হাতদুটো ধরেই থাকলো জিনটা (হাত তার সত্যিই শক্তিশালী) ঝুলেই রইল; অনুচরটি মুহূর্তে ছুটে এল ঘোড়া থামালো এক ঝটাকায়। বাবরের পা মাটিতে অর্ধবৃত্ত এঁকে দিয়েছে; মাথা থেকে তার রেশমী উষ্ণীব পড়ে গেছে, সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে, চাবুকটা তখনও দাঁতে ধরা। মুখটা কেবল ভীষণ মলিন দেখাচ্ছে।
নুয়ান ঘোড়ায় চড়ে তার কাছে এগিয়ে এসে, ঘোড়া থেকে নামলো, উষ্ণীষটি তুলে বাবরকে এগিয়ে দেবে ভাবলো। কিন’ বাবর ধুলোমাখা উষ্ণীষটির দিকে তাকালোও না। চাবুকটা হাতে ধর,ে সহচর ইতিমধ্যেই তার ধূসর ঘোড়াটাকে ধরে এনেছে, কোন কথা না বলে চড়ে বসলো বাবর। ঘোড়াটাকে চাবুক মেরে পথের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাছপালার মাঝখান দিয়ে ছুটিয়ে দিলো। বাগানের প্রান্ত দিয়ে যে পথটা চলে গেছে সাধারণত সে পথেই অশ্বারোহীরা যেতো। কিন’ বাবর গাছপালার মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া পায়ে-চলা সরু পথ ধরে উড়ে চললো। ঘোড়া যখন সরু খাল লাফিয়ে পার হচ্ছিলো তখন বাবরের মাথাটা খুবানিগাছের শক্ত ডালপালায় প্রায় আটকে যাচ্ছিলো। কিন’ বাবর ঝুঁকে পড়ে ঘোড়ার গলাটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সেসব পার হয়ে গেল। তার পায়ের ধাক্কা লেগে খুবানী খসে খসে পড়তে লাগলো খালের পানিতে।
‘তুই ঘোড়াটাকে আরো শক্ত করে ধরলি না কেন রে বোকা!’ ঘোড়া যে ধরেছিল সেই নোকরটিকে ধমক দিল নুয়ান, ‘এখন আমাদের সবার ওপরেই রেগে গেছেন শাহজাদা! তোর জন্য আমাদের সবার কপালেই জুটবে, দেখিস।’
বাগানের মাঝে চমৎকার করে সাজানো দালানের কাছে বাবরের ঘোড়া থামলো। ঘোড়াটাকে ধরবার জন্য একজন নোকর ছুটে এলো, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার উষ্ণীষছাড়া মাথার দিকে। বাবর নিজের অজানে-ই লাল হয়ে উঠলো। এখন নানী এহসান দৌলত বেগম এমনি অবস্থায় তাকে দেখতে পাবেন, জানতে পারবেন কী হয়েছিল, ভৃত্য, সহচররা নিঃসন্দেহে শাসি- পাবে, কারণ ফরগানার বাদশাহ এই এসান দৌলত বেগমের ওপরেই দায়িত্ব দিয়েছেন বাবরকে চোখের মণির মতই আগলে রাখতে আর সেইজন্যই দাসদাসীসমেত গোটা বাগানবাড়ীটাই তার আদেশাধীন করে দিয়েছেন।
বাবরের অনুগত ছেলেগুলি ও সহচররা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে চলল দালানের দিকে। যখন বাবর বাড়ীর ভিতর ঢুকলো তখন তারা নামলো ঘোড়া থেকে। নুয়ান কুকলদাস বাবরের উষ্ণীষ থেকে ধুলো ঝেড়ে হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে। বাবর টুপি মাথায় দিয়ে বেরিয়ে এলো- এবার নানী আর কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবে না। তার কাছে এগিয়ে আসা দলটির দিকে তাকিয়ে দেখলো, যে নোকরটির হাত ছাড়িয়ে ঘোড়াটা লাফ দিয়েছিল সে বাবরের পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতে গেল, কিন’ বাবর তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো, তারপর তাকাল নুয়ান কুকলদাসের দিকে। কী হাস্যকরভাবে সে উষ্ণীষটা ধরে আছে! দু’হাতে সযতনে বইছে যেন এক দামী পাত্র। ভৃত্য-সহচরেরা ভাবছিল রাগে ফেটে পড়বে কিন’ তার বদলে শুনতে পেল হাসি। মজা পেয়ে বাবর শিশুদের মত সুরেলা গলায় হা-হা করে হাসছে মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে। নুয়ান কুকলদাসও এবার হাতে ধরা উষ্ণীষটাকে অন্য চোখে দেখল, সেও হেসে উঠল। বুকের থেকে বোঝা নেমে গেল যেন তাদের। হাসতে লাগল বাকী সবাইও। হাসি থামিয়ে বাবর যার হাতে থেকে ঘোড়া লাফিয়ে সরে গিয়েছিল সেই ছেলেটিকে বললেন, ‘তোর কোন দোষ নেই….’
ছেলেটি এমন উপহার পেয়ে সমানে কুর্ণিশ করতে করতে পিছিয়ে গেল আসে- আসে-। বাবর এবার নুয়ানকে বললেন, ‘নানী যেন কিছু না জানতে পারেন।’
‘আমাদেরও তাই ইচ্ছা শাহজাদা।’ খুশী হয়ে উঠল নুয়ান, বন্ধুদের দিকে চোখ টিপলো।
সবাই তারা বয়সে তরুণ, সবাই বোঝে তরুণদের গোপন কথা কী হতে পারে। ওদের প্রায় সবার কাছেই লেখাপড়া করাটা খুবই অরুচিকর ব্যাপার ছিল। বাবরের মনে পড়ে গেল আজ মুদার্রিস পড়াতে আসবেন। তরুণ মির্জার মেজাজ আবার খারাপ হয়ে গেল।
২
এই বাগানবাড়ীর ভিতরটা প্রাসাদের মতই-জাঁকজমকপূর্ণ আসবাবপত্র, প্রচুর অলঙ্করণ আর দরজাতেও খোদাইকরা। এই বাড়ীটির কেবল একটি ঘরই ভাল লাগতো বাবরের। বাবর ঘুরে সেই ঘরটির দিকে চললেন যেখানে তার প্রিয় কিতাবগুলি রাখা আছে, যদিও ওদিকে মুদার্রিস তার অপেক্ষায় আছেন। সোনাবাঁধান পাতাগুলি, মখমল আর চামড়ায় বাঁধাই এসবই মহান কবিদের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ধরে রেখেছে বলে তার মনে হতো। ফিরদৌসি, সাদী, নবাইয়ের শ’য়ে শ’য়ে বয়াৎ মুখস্থ বাবরের। ‘ফরহাদ-শিরী’ হাতে নিয়ে সে কল্পনার চোখে দেখতে থাকে দূর হীরাটে বসবাসকারী আলি শেরকে। আন্দিজানের স্থপতি মেল্লা ফজল উদ্দিন, যিনি লেখাপড়া শিখেছেন, সোনার জলে কাজ করা, মর্মর পাথরের জলাধার সমেত এই বাগানবাড়ী নির্মাণের সময়ে মির আলিশেরের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা বলেছেন বাবরকে। হীরাট থেকে স্থপতি নিয়ে এসেছিলেন নবাইয়ের প্রতিকৃতির একটি নকল, এটি সেই প্রখ্যাত বেহ্জাদ অঙ্কিত প্রসিদ্ধ প্রতিকৃতির নকল। মহান কবির প্রতি বাবরের প্রচন্ড আগ্রহের কথা জানতে পেরে স্থপতি তাকে সেই ছবিটি উপহার দেন। বিশালাকায় ‘ফরহাদ-শিরী’ বইটির মধ্য থেকে ছবিটি বার করল বাবর, শরীয়তের পাঠ যে খাতার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো।
শরীয়তের পাঠ আরম্ভ হবার সময় হয়েছে।
বৃদ্ধ মুদার্রিস, ঘন ভ্রু, সাদা লম্বা দাড়ি দেহের প্রায় নাভি ছুঁয়েছে, পাঠকক্ষের মাঝখানে রেশমী গদীতে বসে। ফারসী ভাষায় ফিকাহের কানুন বুঝাতে আরম্ভ করলেন প্রথমে মুদাররিস। বাবর আরবী, ফারসী দুই-ই ভাল জানত, আইনকানুন সম্পর্কেও তার আগ্রহ, কোরানে হাফেজ হয়ে গিয়েছিলেন ইতিমধ্যেই, আবৃত্তি করতে ভালবাসত, কিন’ এখন তার ভেতরের উদ্দামতা ফুটে বেরোবার চেষ্টা করছে ফেটে বেরিয়ে এই নিরস পাঠ শুনতে হবে তাকে। শোনার দরকারই বা কী- এমন ভাব দেখান যায় যে যেন শুনেছে, আসলে… ফরহাদের বীরত্ব সম্পর্কে বয়াৎ মনে করা যাক দেখি…
পৌরুষ শিখতে চাও? শেখো তবে মরদের কাছে।
সতর্কভাবে, যাতে মুদার্রিস দেখতে না পান, বাবর খাতার ভিতর থেকে তসবীরটি বার করলো। কালো, লম্বা চেকমেন পরে নবাই দাঁড়িয়ে আছেন সরু লাঠিটার ওপর সামান্য ভর দিয়ে, চোখের দৃষ্টিতে মায়াভরা। বাবর মনে মনে বললো, হে আজীম আমীর, যদি আপনার সামনে দাঁড়াবার মত ভাগ্য হয় আমার… আর যদি ফরহাদের মত আমার পথে পড়া সমস্ত ড্রাগন আর ডাইনীদের জয় করতে পারি আমি… তাহলে কি আপনি আমাকে কাব্যের জগতে প্রবেশের পথ দেবেন?
মুদার্রিস ধীরে ধীরে উঠে, অপ্রত্যাশিত দ্রুত এগিয়ে এলেন বাবরের দিকে। ছবিটি লুকিয়ে ফেলার সময় পেল না বাবর।
‘ইনসানের তসবীর?’ হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মুদার্রিস। ‘সবক শেখার সময়ে? কুরান শরীফ আর হাদীসে মানা আছে।’
মুদার্রিস নবাইয়ের শায়েরের কথা শুনেছেন, কিন’ পড়েন নি।
‘ইনসানের তসবীর, হায় শাহজাদা, এ যে শয়তানের ব্যবহার। দিন তো আমাকে ছবিটা দিন দেখি।’
মুদার্রিস এমন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন যেন মনে হল ছবিটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলবেন এখুনি। বাবর বলল, ‘না।’ এমন জোর দিয়ে বলল যে শিক্ষকের ভয় হল ভাবী শাহ্কে রাগিয়ে দেবার। কিন’ পাঠ বন্ধ করে তিনি এসান দৌলত বেগমকে নালিশ জানাতে গেলেন।
সাদা মখমল পোশাকের খসখস আওয়াজ তুলে বছর পঞ্চান্ন বছর বয়সের স্থূলকায়া এক মহিলা এসে ঢুকলেন পাঠকক্ষে। বাবর লাফিয়ে উঠে অভিবাদন জানাল নানীকে। এহসান দৌলত বেগম সর্বনেশে ছবিটা হাতে তুলে নিলেন। সাগ্রহে লক্ষ্য করতে লাগলেন সেটি।
‘মির আলি শেরের মুখে দেখছি ফেরেশ্তার ভাব’, শিক্ষককে বিস্মিত করে দিয়ে বললেন তিনি। তারপর পিছন ফিরে রেশমী রুমালের প্রান্ত দিয়ে মুখ ঢেকে বললেন, ‘খোদাবন্দ মুদার্রিস, মোল্লাদের অনুমতিক্রমেই এই তসবীর আঁকা হয় হীরাটে।’
‘মাফ করবেন মালকীন’, মুদার্রিস দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে, ‘ভাবী শাহ্কে জানাতে চাই যে, পয়গম্বর মুহম্মদ (সঃ), তার পবিত্র নাম বেঁচে থাক, আমাদের দিয়েছেন খাঁটি ইসলাম ধর্ম, যা আছে কেবল মাভেরান্নহরে।’
এহসান দৌলত বেগম বাবরের দিকে ফিরলেন, ‘মুদার্রিস সাহেব অবশ্যই ঠিক কথা বলেছেন, ফিকাহ্ পাঠের সময়ে কোন ধরনের ছবি দেখাই শোভা পায় না। সময়ে খোদার ইচ্ছায় তুমি দেশ শাসন করবে। ফিকাহ্ তোমার জানা উচিত আদ্যোপান্ত। আর ছবিটা…. আমি নিজের কাছে রেখে দেব।’
বাবর কাকুতিমিনতি করে এক মুহূর্তেই ছবিটি আদায় করে নিল নানীর কাছ থেকে, আবার বইয়ের মধ্যে রেখে দিল সেটা।
‘আমার স্বপ্নকল্পনা আপনার হাতে তুলে দিলাম’, এহসান দৌলত বেগমের হাতে বইটি তুলে দিতে দিতে বলল বাবর। নাতির কথা মনে ধরল নানীর।
‘মীর আলি শেরকে আন্দিজানে আমন্ত্রণ জানালে কেমন হয়?’
‘তা কি সম্ভব?’ বাবরের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
‘মির আলিশের সমরখন্দের আতিথ্য গ্রহণ করে সমরখন্দকে সম্মানিত করেছেন। আর ফরগানার সুনাম তামাম দুনিয়ায়। শুনেছি মীর আলি শের শরীফ, ধার্মিক এক কথায় একজন পাক ইনসান তিনি। যদি তিনি এখানে আসেন তো খুদাবন্দ মুদার্রিসও সে প্রমাণ পাবেন।’
মুদার্রিসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এবার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বেশ গম্ভীরভাবে বললেন তিনি, ‘আল্লাহ্র ইচ্ছাই পূর্ণ হোক….’
৩
দ্বিপ্রহরে চতুর্দিক নিস্তব্ধ।
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে সবাই অধীর প্রতীক্ষায় আছে সন্ধ্যায়। বড় বড় বাড়ীর ধনী মালিকেরা এই সময়টা কাটায় ঠান্ডা ঘরে ঘুমিয়ে, ক্ষুধাতৃষ্ণার হাতে থেকে বাঁচে।
বাবরের ঘুম আসছে না কিছুতেই তার কাব্যিক চিন্তাধারা উত্তেজিত করে তুলেছে তাকে। একা ঘরে বসে কাগজকলম হাতে তুলে নিল সে। কবিতা লেখার চেষ্টা করল, কিন’ অন্যদের লেখা কবিতার পংক্তিগুলি ছাড়া আর কিছু আসছে না মাথায়। তখন অন্য একটা খাতা খুলে ফরগানা উপত্যকার কথা যা জানে লিখতে আরম্ভ করল,
“এখানে আছে উঁচু পর্বতমালা আর অনেক শিকার। আখ্সি থেকে সামান্য দূরে মরুভূমি এলাকায় আমরা সাদা হরিণ দেখেছি। মার্গিলানের কাছাকাছিও আছে। ফরগানা উপত্যকা কী অপরূপ! তার সমস্ত সৌন্দর্য আর বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিতে পারলে কী ভালোই না হতো। হীরাটে মীর আলি শেরের কাছে লোকে তো কেবল কবিতা নিয়েই আসে না….”
বাবর লেখায় এমন মগ্ন ছিল যে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ শুনতে পেল না। শুনতে পেল কেবল তখনই যখন অশ্বারোহী এসে থামল বাড়ীর কাছে।
কিছুক্ষণ পরে নিস্তব্ধ বাড়ীর কোন একটা ঘর থেকে নারীকণ্ঠে কান্নার সুর শোনা গেলো। কেঁপে উঠে বাবর কাগজ থেকে মাথা তুললো। একি, কী হলো? যে মহলে এহসান দৌলত বেগম থাকেন, সেদিক থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ। ক্রমশ বাড়ছে কান্নার আওয়াজ। বাবর তাড়াতাড়ি লাফাতে লাফাতে ছুটে চলল নানীর মহলের দিকে।
তার শোবার ঘরের দরজা খোলা। বৃদ্ধা মহিলার মাথার আবরণ খসে পড়েছে। মেয়ে কুতলুগ নিগর-খানমের চিঠিটা বারবার পড়ছেন, আর নিজের অজানে-ই দলা পাকাচ্ছেন খামটাকে, চোখ জলে ভরে উঠেছে, লেখা কিছুই চোখে পড়ছে না।
যে সৈন্যটি আখসি থেকে মির্জা ওমর শেখের মৃত্যুর খবর নিয়ে এসেছে, দাঁড়াবার শক্তি নেই তার, বাবরের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে লাগলো সে কাসেম বেগের দিকে তাকিয়ে। কাসেম বেগ শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে এগিয়ে এলো বাবরের দিকে, নতজানু হয়ে বসলো তার সামনে। রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে মিনতি ঢেলে বললো, ‘শাহ্জাদা!… খোদা আপনাকে শক্তি দিন। এখন আপনিই আমাদের একমাত্র আশ্রয়! তিন দিক থেকে শত্রু আসছে। … আপনার আম্মাজান আদেশ দিয়েছেন…. অবিলম্বে আপনাকে আন্দিজান যেতে আর বিশ্বস্ত বেগদের কেল্লায় ডেকে পাঠাতে…’
এহসান দৌলত বেগম বুঝলেন এই বিপদের মুহূর্তে কর্তব্য থেকে সরে থাকলে চলবে না, কাঁদবার সময় নেই এখন। কাসেম বেগকে বললেন, ‘উঠুন… আপনার বিশ্বস্ততার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। মির্জা বাবরের সঙ্গে যান। সবাইকে এ বাড়ী ছাড়তে হবে, সবাইকে কেল্লায় যেতে হবে।’
বাবর যেন পাথর হয়ে গেছে। বিনাবাক্য ব্যয়ে কোনরকমে পোশাক পরলো, ঘোড়ায় উঠলো। চারপাশে তাকালো একবার। এই ফুল-ফলেভরা গাছগুলি, এই মর্মরপাথরের ভরাট জলাধার এসবই তার পিতার তৈরী- এরাও যেন তার শোকে কাতর- কোনদিনই তিনি আর আসবেন না এখানে। ঐ নাসপাতি গাছের চারাগুলি ওমর শেখ নিজ হাতে বসিয়েছিলেন সেগুলি ইতিমধ্যেই ফল ধরছে, কিছুদিনের মধ্যেই সে ফুলগুলিতে পাক ধরবে; যিনি গাছ লাগালেন তিনি তাদের ফল কখনও চেখে দেখবেন না।
ওরা চলছেন পাথরবিছানো পথ দিয়ে। বাবরের মনে হল তার পিতার কথা, এ পথে পাথর বিছানো হয়েছে তারই আদেশে। দূরের ঐ কেল্লাটাও তার তৈরী। তিনি আর নেই! নেই, নেই! এবার সে পুরোপুরি বুঝলো যে আর কখনও পিতাকে দেখতে পাবে না, এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। হঠাৎ তার দুচোখ জলে ভরে গেল, জল নেমে এল তার বুক ভেঙে দিয়ে আর একই সঙ্গে হালকা করে দিয়েও।
ওরা যখন কেল্লার কাছাকাছি পৌঁছালো (গভীর পরিখা, দেওয়াল উঁচু, এগার স্তর ধাপ যান্ত্রিকভাবে গুণলো বাবর), কেল্লার প্রধান ফটক দিয়ে বেরিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এলো পাঁচজন অশ্বারোহী। সবার সামনে ধূসর রংয়ের ঘোড়ায় চড়ে আসছে ছোট ছোট চোখ, মঙ্গোলীয় চেহারার এক বেগ (বাবর জানতো ইনি মায়ের দিক থেকে একজন আত্মীয়) বাবরের কাছে এসে শেরিম তাগাই বাবরের মুখে শোকের ছাপ দেখে লাফিয়ে নামলো ঘোড়া থেকে। চোখে জল বের হলো না, কিন’ আর্তনাদ করে উঠলো, ‘বিশ্বাস হচ্ছে না, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না শাহ্জাদা। একথা সত্যি যে আমাদের আর কোন আশাভরসা নেই। … হায় কী নিষ্ঠুর এই দুনিয়া।’
এখবর এখনও গোপন থাকারই কথা। কাসেম বেগ জিজ্ঞাসা করলো, ‘কোথা থেকে শুনলেন?’
শেরিম বেগ জামার গলার কাছটা আঁকড়ে ধরে বলল, ‘খোদা যে কীভাবে কী করেন তা সবারই অজানা। … আমার একটা ডাকপায়রা উড়তে উড়তে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিল। কে ওকে নামাল? এই ভেবে দেখবো বলে ছাদে উঠলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে পায়রাটা উড়ে এসে বসল আমার কাছে। ডানার নীচে তার এক টুকরো কাগজ। সেটা নিয়ে ভাঁজ খুলে পড়ে দেখি এই খবর লেখা! কে লিখেছে জানি না, হয়ত কোন ফেরেশ্তা।’
শেরিম বেগ বাবরের কাঁধে হাত রেখে মুখ কাছে এনে আসে- করে বললো, ‘মির্জা, কেল্লার ভিতরে যাবেন না, বিপদ আছে।’
কাসেম বেগও সেকথা শুনতে পেল। ওমর শেখের জীবিতকালে শেরিম বেগ উঁচু পদ পায়নি তাই মন খারাপ করে ঘুরতো। এখন সবার আগে মির্জা বাবরকে সাহায্য করে তার বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করছে পদোন্নতির জন্য। সেকথা বুঝে কাসেম বেগ শান্তসুরে বলল, ‘শাহ্জাদা, বিপদের মুখোমখি হবার আগেই ভয়ে কাতর হই না আমরা। তাড়াতাড়ি করে কেল্লায় ঢোকা উচিত আমাদের, যাতে বেগদের জড় করতে পারা যায়।’
মাটিতে দাঁড়িয়ে অশ্বারোহীর সঙ্গে কথা বলা অসম্ভব বলে মনে করে শেরিম বেগ। ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে সে নিষ্ঠুর সুরে বলল, ‘আপনি এখনও জানেন না কী ঘটছে, খোদাবন্দ কাসেম বেগ। আপনাদের বিশ্বস্ত বেগরা দুশমনের হাতে তুলে দিয়েছে খজেন্ত! ইসফরা গেছে! মার্গিলানও।’
চীৎকার করে কেঁপে উঠল বাবর, ‘মার্গিলান? কবে?’
‘এখুনি খবর এসেছে। দুশমন যেন শরতের মেঘের মত নেমে আসছে দুনিয়ার ওপর। কুভার দিকে এগিয়ে আসছে তারা! এবার আন্দিজানের পালা!… আপনার কি এই ইচ্ছে যে আপনাদের বিশ্বস্ত বেগরা মির্জা বাবর সমেত আন্দিজান কেল্লা দুশমনের হাতে তুলে দিক? না! যতক্ষণ আমি বেঁচে…’
শেরিম বেগ বাবরের কাছে এগিয়ে এসে তার ঘোড়ার লাগামটা ধরল, ‘আমি আপনার মামা, শাহ্জাদা, আমি আপনার অনুগত, আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে অনুমতি দিন।’
শেরিম বেগ কী বলছে বাবর কিছুই বুঝতে পারছিল না কিন’ শোকার্ত প্রাণ বদ্ধ কেল্লার হাঁফ ধরা পরিবেশ থেকে খোলাবেলা জায়গায় যেতে চাচ্ছে। তাই বাবর কোন প্রতিবাদ করলেন না। কাসেম বেগ কিন’ আবার বাধা দেবার চেষ্টা করলেন, ‘শাহ্জাদা, আপনার আম্মাজান, ওয়ালিদা সাহেবা কিন’ সম্পূর্ণ অন্য আদেশ দিয়েছেন।…’
‘কুতলুগ নিগার-খানম তো আর সিপাহসালার নন!’ জেদীভাবে বাবরের ঘোড়াকে ঘোরাতে ঘোরাতে কাসেম বেগের কথার মাঝখানেই শেরিম বেগ বলল।
কাসেম বেগও কম জেদী নয়, সেও বাবরের কাছে এগিয়ে এসে বাবরের ঘোড়ার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, ‘আপনার ওয়ালিদা সাহেবা, আমাদের মালিকা আজ বাদশাহের দাফন হয়ে যাবার পরই আন্দিজান পৌঁছে যাবেন। আপনার নানীও কেল্লায় চলে আসতে চেয়েছেন। ওঁরা আপনাকে কি করে খুঁজে পাবেন?’
বাবর এবারে চেতনা ফিরে পেল খানিকটা। শেরিম বেগকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাব আমরা?’
শেরিম বেগ কানে কানে বলল, ‘আলাতাউর দিকে যাব। ওশ, না হয় উজগেন্দ!’
বাবর কাসেম বেগের কাছ থেকে গোপন করতে চাইলো না এই পথের কথা। নীচুসুরে তাকে বলল, ‘ওশের কাছাকাছি কোথাও। ওয়ালিদা সাহেবাকে বলবেন।’
‘প্রথমে আমি কেল্লার বেগদের সঙ্গে কথা বলে দেখব, শাহ্জাদা, ওরা কী ভাবছে।’
‘আমার ওস্তাদ খাজা আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করাই উচিত হবে আপনার।’
‘যে আজ্ঞা!’ কাসেম বেগ ঘোড়া ছোটালো কেল্লার দিকে।
৪
তাদের এই আলোচনা কেল্লা প্রাচীরের খাঁজে চোখ রেখে লক্ষ্য করছিল মোটা এক সিপাহী। যখন কাসেম বেগ দ্রুত রওনা হলো কেল্লার ফটকের দিকে তখন সিপাহীটি ধীরে সুসে’ পাঁচিল থেকে নেমে তার মনিব আহমদ তনবালের কাছে চললো…
বিশাল খুবানী বাগানের মাঝে গম্বুজওয়ালা, টালিবসান এক হামাম। বাগানের মালিক ইয়াকুব বেগ উত্তপ্ত গ্রীষ্মের দিনে এর একটি ঘরে বিশ্রাম করতেন। ঘরের ভিতরটা রাজপ্রাসাদের অতিথিশালার মত করে সাজান। সেই ঘরে সম্মানের আসনে এখন বসে আছেন আহ্মদ তনবাল। বড় শুকনো কুমড়োর খোল থেকে বনগোলাপ আঁকা পেয়ালায় কুমিস ঢেলে খেয়ে নিয়ে সে ঘোঁত ঘোঁত করলো।
‘আল্লাহ্ গুনাহ্ মাফ করবেন, আজকের রোজা ভাঙতে হলো।’ স্বাভাবিক সুরে বলল সে। পথে আসার সময়ে তৃষ্ণায় জিভ তালুতে ঠেকে গিয়েছিল একেবারে। ‘আর একটু হলে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম ঘোড়া থেকে।’
‘এখন কোন গুনাহ্ হবে না আপনার’, বলে একটু ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন ইয়াকুব বেগ। ‘যখন অতি প্রয়োজন তখন কোন দোষ হয় না।… আপনি একটা মস্ত কঠিন কাজ করতে যাচ্ছেন। যদি আপনি সফল হন আর মির্জা জাহাঙ্গীর তখ্তে বসেন, তবে আপনি হবেন তার সবচেয়ে বিশ্বাসী ব্যক্তি। উজীর আজম, তাই না?’
আহমদ তনবাল ভেতরে ভেতরে সুখে গলে যাচ্ছিল নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। স্থূলকায় ইয়াকুব বেগের মুখে মৃদু হাসি। মুখে সামনের দুটো দাঁত নেই- হাসিটা আরো হাস্যকর দেখালো। চোখে যেন জিজ্ঞাসা, তখন কি তুমি ভুলে যাবে যে এই ভয়ঙ্কর খেলায় আমিও হাত লাগিয়েছিলাম?
সতর্ক হয়ে গেল আহমদ তনবাল।
‘বেগ সাহেব, আপনি আমি দু’জনেই মোগল। ফরগানা বারলাসদের প্রভুত্ব ঘুচিয়ে দেবার সময় এসেছে। এবার আমাদের পালা। আমাদের মোগল বেগদের মধ্যে আপনাকেই সবার বড় বলে মনে করি আমি। আল্লাহ্র মর্জিতে উজীর হলে আপনি হবেন আমার একমাত্র বন্ধু ও উপদেষ্টা।’
‘আল্লাহ্র মর্জি পূর্ণ হোক।’ সন’ষ্টভাবে বলে ইয়াকুব বেগ নিজের ছোট করে ছাঁটা দাড়িতে হাত বুলালো।
আহমদ তনবাল পেয়ালাটা একপাশে ঠেলৈ সরিয়ে দিল তারপর দরজার দিকে ফিরে কান পেতে শুনলো। নোকর ভিতরে ঢুকে কুর্ণিশ করলো।
‘বখশিশ দিন, মালিক, বখশিশ! মির্জা বাবর কেল্লায় ঢোকেন নি, অন্য দিকে চলে গেছেন।’
‘শেরিম বেগের সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ।’
আহমদ তনবালের কাছে এটা খুশীরই খবর। চামড়ার থলি থেকে একটা মোহর বের করে দরজার দিকে ছুঁড়ে দিল সে। ভৃত্যটি মোহরটি চটপট তুলে নিয়ে চালান করে দিল জামার ভিতরে। আবার কুর্ণিশ করে কৃতজ্ঞতা জানাল। তারপর আহমদ তনবালের ইঙ্গিতে দরজাটা শক্ত করে বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল।
আন্দিজানে পৌঁছে আহমদ তনবাল প্রথমেই এসে উঠেছে ইয়াকুব বেগের কাছে। কিন’ মির্জা ওমর শেখের মৃত্যুসংবাদ প্রথম তাকেই দেয়নি, দিয়েছে শেরিম বেগকে। শেরিম বেগ ব্যস্তবাগীশ আর অল্পেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। একটু বোকসোকা গোছের। আহমদ তনবাল নিজে আড়ালে থেকে পায়রা দিয়ে যে চিঠিটা পাঠির্য়েছিল তাতেই বিশ্বাস করে বসলো।
‘আপনার উপদেশ অনুযায়ী মতলব দারুণ ফল দিয়েছে’, বাড়ীর মালিকের প্রতি আনুকুল্য দেখিয়ে বলল আহমদ তনবাল।
‘হ্যাঁ, শেরিম বেগ এবার তার ভাইপোকে ভাল করেই বাঁচাবে বিপদের হাত থেকে। বাবরের বিশ্বস্ত বেগ হবার জন্য প্রাণপাত করবে, আলাতাউয়ের ওপাশে নিয়ে যাবে তাকে, আল্লাহ্র রহম …’
‘এবার আমরা… লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেব বাবরের পালিয়ে গেছে।…. বিপদ দেখে পালিয়েছে। লোকেরা জানুক, এই বিপদের দিনে বাবর আন্দিজান ছেড়ে পালিয়েছেন। এরপরে… এরপরে মির্জা জাহাঙ্গীর তখ্তে বসবেন।’
ইয়াকুব বেগ দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়েই চলেছে।
‘গুজব ছড়ানোর সব থেকে উপযুক্ত জায়গা হল বাজার’, বলল সে। ‘এ জন্য উপযুক্ত কয়েকজন ব্যাপারী আছে আমার, তারাই বলবে।’
‘ঠিক, কিন’ কেউ যেন না জানে যে গুজব ছাড়াচ্ছি আমরা।’
‘নিশ্চিন্ত থাকুন, আহমদ বেগ। আমরা গোপন কথা গোপন রাখতে জানি।…’
আন্দিজানের লোকেরা এমনিতেই একটার পর একটা দুঃসংবাদের গুজবে অসি’র। শত্রুদের এগিয়ে আসার সংবাদে সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত, আর যেখানে আশংকা সেখানেই গুজব। লোকে কানাকানি করছিলো বাদশাহ্ খাড়া পাড় থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন, আজকালের মধ্যে শত্রু দখল করে নেবে শহর। তারপর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল, মির্জা বাবর কাপুরুষ, পালিয়েছেন, আমাদের ভাগ্যের হাতে ফেলে। বেচাকেনা যখন খুব জমজমাট। কোথা থেকে আসছে খবর তা কেউ জানে না, কিন’ তারা শুনছে, অন্যদের বলছে, বলার সময় আরো কিছু ভয়ঙ্কর খুঁটিনাটি যোগ করছে। শেষ অবধি শোনা যেতে লাগল যে আখসি কেল্লার পতন হয়েছে, বাদশাহ্কে খাড়া পাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। গুপ্তচরেরা তাড়াতাড়ি নগরপালকে জানাতে চলল আজ নতুন কি কথা শুনেছে।
বেগরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। কাসেম বেগ বাদশাহের মৃত্যুর খবর আনতে তারা শত্রুভয়ে আরো ভীত হয়ে পড়ল। সিংহাসনের উত্তরাধিকারী পরিবর্তিত হওয়ায় সম্ভাবনায় তারা যুদ্ধের কথা আর চিন্তা করতে পারছে না। উল্টোপাল্টা গুজবে নগরপাল উজুন হাসানের মাথা ঘুরছে। বাজে গুজব কিন’ কে বলতে পারে…
বেগরা সমবেত হলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘নগরপাল সব শেষ হল এবার। কেল্লার বাইরে দুশমন আর ভিতরে গোলমাল। কিছুই জানি না আমরা, কিছুর জন্য প্রস্থতও নই। … মির্জা বাবর যে কেল্লায় না ঢুকেই চলে গেলেন তা অমনি অমনি নয়।’
‘আমাদেরও পালিয়ে যাবার দরকার নাকি?’ ব্যঙ্গ করে বললেন মওলানা আবদুল্লাহ।
খাজা আবদুল্লাহর খ্যাতি ছিল তার কালো চুল আর গভীর জ্ঞানের জন্য। আন্দিজানের বেগদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রভাবশালী পীর। মির্জা বাবর নিজেকে তার মুরশিদ বলে মনে করতো, তাই উজুন হাসান কালো দাঁড়িওয়ালা খাজার কথার কোন অশিষ্ট উত্তর দিতে পারলেন না। চুপ করে গেলেন।
‘মির্জা বাবর আন্দিজান থেকে বেশী দূরে চলে যাবার আগেই ফিরিয়ে আনতে হবে তাকে’, বলল কাসিম বেগ।
‘মির্জা বাবরকে আমি বেশ ভালই বুঝতে পারি’, সমবেত সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে বললেন খাজা আবদুল্লাহ। ‘না, না, তিনি ভয়ে পালান নি, তিনি আমাদের ছেড়ে গেছেন আমাদের তার প্রতি বিশ্বস্তার প্রমাণ পাবার জন্য। আর বাজারে গুজব ছড়ানো হচ্ছে গোলমাল বাধাবার জন্য। দাঙ্গাবাজরা গোলমাল বাধাতে চাচ্ছে। তাদের থেকেই বাজারের লোকেরা বাদশাহের মৃত্যুর খবর আমাদেরও আগে জেনেছে।’
‘ঠিক, ঠিক!’ দারুণ বিস্মিত হয়ে গেল উজুন হাসান, খাজা আবদুল্লাহ এখানে তাদের মধ্যে বসে মির্জা বাবরের চিন্তাধারা অনুমান করতে পারছেন। প্রকৃতই বড় পীর এই খাজা। ‘আমাদের পীরের কাছে দেখছি সবই পরিষ্কার,’ উজুন হাসানের স্বরে গভীর শ্রদ্ধা। ‘মওলানা যা বলেন আসুন আমরা তাই করি।’
‘আমি বুঝতে পারছি,’ গলা নামিয়ে বললেন খাজা আবদুল্লাহ, ‘সবাই একজোট হয়ে মির্জা বাবরের অধীন হবে, তবেই আমাদের রক্ষা-কারো মাথা থেকে একটা চুলও খোয়া যাবে না।’
ঠিক কথা। কী দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে বলছেন খাজা আবদুল্লাহ। যাই হোক…. ভয় লাগছে কেমন যেন,… যদি শেষ পর্যন্ত খাজা আবদুল্লাহর কথাই ঠিক হয়ে দাঁড়ায়, মির্জা বাবর ফরগানার বাদশাহ্ হন তো নগরপালের আজকের দ্বিধা তাকে কোথায় দাঁড় করাবে? নগরপালের পদ থেকে বিদায়? না, না, উজুন হাসান তোমার বেছে নেওয়া পথ থেকে সরে গেলে তোমার চলবে না।
‘পীরসাহেব, আপনি দোয়া করেন, আমি নিজে মির্জা বাবরের কাছে যাই,’ বলল উজুন হাসান, ‘আমি সব বেগদের তরফ থেকে তাকে আমাদের আনুগত্য জানাবো এবং কেল্লায় আমন্ত্রণ জানাবো।’
‘আপনার অভিলাষ প্রশংসার যোগ্য। কিন’ আমি বলতে চাই যে যতক্ষণ আপনি নগরপাল ততক্ষণ আপনার উচিত শহরে গোলমাল দূর করা, দাঙ্গাবাজদের ঘাঁটি খুঁজে বার করে তাদের বিনাশ করা, আন্দিজানে প্রতিরক্ষার প্রস্থতি নেওয়া। এভাবেই মির্জা বাবরের অনুগ্রহ পাবেন আপনি।’
উজুন হাসানের মনের কথা সত্যি সত্যিই পড়ে ফেলেছেন পীরসাহেব।
গ্রীষ্মের প্রখর সূর্যতাপে পৃথিবী-আকাশ দুই-ই জ্বলছে। ঘোড়ার খুরের আঘাতে যে ধূলো উড়ছে তা আগুনের শিখার মত এসে লাগছে অশ্বারোহীদের চোখে মুখে। একটু হাওয়া নেই।
দরদর করে ঘামছেন বাবর, অসহ্য তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ। গতকাল এমন সময় তিনি আন্দিজানে নদীর তীরে বসে আরাম করছিলেন। শ্যামল ছায়াভরা বাগানবাড়ীর বিশুদ্ধ বাতাস, স্বচ্ছ জল, হাওয়া-খেলানো বারান্দা, নিশ্চিন্ততা, ছেলেমানুষি- এ সবই অতীতের কথা, এই রোদ-জ্বলা ধুলো ভরা পথে চলতে চলতে সেই দিনগুলির কথা মনে হচ্ছে যেন বহু যুগ আগের কথা। যেন হঠাৎ এক ঘূর্ণিঝড় এসে কিশোরকে সুখের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে নির্জীব কাঠকুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে চলেছে দূরে কোথাও, ঠিক যেমন হয় ভয়ংকর কোন রূপকথায়। এই ধূলো উড়িয়ে আনছে এক ঘূর্ণিঝড়। এমনই এক ঘূর্ণিঝড় তার পিতাকেও নদীর খাড়া পাড় থেকে ছুঁড়ে ফেলেছে। আর তার পঞ্চাশজন সঙ্গীর ঘোলাটে ধূলি-ধূসর ছায়া- এও তাদের সবাইকে একই বিপদের মধ্যে তাড়িয়ে নিয়ে আসা সেই ঘূর্ণিঝড়েরই ছায়া।
খিদেয় মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে যেন এক অশুভ দৈত্য, দূরে পর্বতরাশি দেখা যাচ্ছে। দৃষ্টি দিয়ে বাবর শীতলতা অনুভব করলেন। ঘোড়াকে পায়ের জুতোর কাঁটা দিয়ে ঘা মারলেন। কষ্টে শুকনো ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে শেরিম বেগকে বললেন, ‘জলদি! সবাই একটু জলদি চলুন।’
শেরিম বেগ পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দূত আসছে। একটু অপেক্ষা করা যাক?’
দূত বাবরের হাতে দিল খাজা আবদুল্লাহর লেখা চিঠি। বাবর গোল করে পাকান চিঠিটা হাতে নিয়ে রেশমী সুতোটা ছিঁড়ে খোলা চিঠিটা এগিয়ে দিলেন নুয়ান কুকলদসের দিকে, ‘পড়ূন।’
চিঠিতে লেখা আছে আন্দিজানের বেগদের আনুগত্যের কথা। আরো আছে- সতর্ক ইঙ্গিতের মাধ্যমে- শহরে নোংরা গুজব ছড়িয়েছে যে মির্জা বাবর পালিয়েছেন, এইভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা লোকের মনে তার সম্বন্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে।
‘আমি ঐ ষড়যন্ত্রকারীদের হাত থেকেই তো আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম শাহজাদা।’ বাবরকে শেরিম বেগ বলে উঠল। ‘খুবই খারাপ অবস্থা। কেল্লাতেই ওরা ঘাঁটি গেড়েছে। ফিরে যাবেন না শাহজাদা। বেগরা যদি আপনার অনুগতই হয় তো এখানে আসুক।’
ভয়ে বাড়ী ঘর ছেড়ে পালিয়েছে, হ্যাঁ এমন একটা গুজব ছাড়বেই এক মুখ থেকে আর এক মুখে, শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে।
‘না! পালিয়ে যাব না আমি।’ ঘোড়া ফেরালেন বাবর।
‘এ একটা ফাঁদ, শাহজাদা, বিশ্বাস করুন।’
‘আমি নিজেই সব সিদ্ধান্ত নেব! ওদের দেখিয়ে দেব যে আমি ভীরু নই। ফিরে চল সবাই। ফিরে চল আন্দিজান।’
ঘোড়ার লাগামটা ঢিলে করে দিয়ে বাবর চাবুকের এক আঘাতে ঘোড়া ছোটালেন। প্রচন্ড গতিতে দৌড় লাগাল ঘোড়া, হাওয়া এসে ধাক্কা দিল বাবরের বুকে, তাতে ভারী আরাম লাগল তার। যেন সেই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়টা পিছনে পড়ে গেছে, মিলিয়ে গেছে পথে।
যখন তারা কেল্লায় এসে ঢুকলেন সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সন্ধ্যা বেলায় সাধারণত রাস্তায় খুব হৈচৈ, গোলমাল থাকে, কিন’ আজ চারদিক নিস্তব্ধ। দোকান পাট বন্ধ। চারদিক কেমন খাঁ-খাঁ করছে। শহরবাসী ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে যে যার ডেরায় ঢুকেছে।
বাবর আগে আগে যাচ্ছিলেন। শেরিম বেগ বাবরের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে ঘিরে ফেলতে নির্দেশ দিল ইঙ্গিতে। নিজে মির্জার নাগাল ধরবার জন্য এগিয়ে চলল। আবার বাবরের মনে হল তিনি ঘূর্ণিঝড়ের কবলে বন্দী। চোখের সামনে আবার লোক, ঘোড়া ঘুরপাক খেতে লাগল- যেন ঘূর্ণিঝড়ের স্তম্ভে ঘুরতে থাকা খড়কুটো। আবার বাবর ঘোড়াকে আঘাত করে বেড় ভেঙে সবার আগে এগিয়ে গেলেন। শেরিম বেগ আবার চেষ্টা করল বাবরকে ধরে ফেলে তার সঙ্গে সঙ্গে যেতে, যে দেখে দেখুক, কুদৃষ্টি থেকে সে বাঁচাবে ভাইপোকে। কিন’ নুয়ান কুকলদাস তার ঘোড়ার লাগামটা ধরে বলল, ‘যেতে দিন হুজুর, শাহ্জাদা আগে আগে চলুন। লোকে দেখুক সিংহাসনের উত্তরাধিকারীকে, স্বসি- পাক তারা। ঐ যে ওরা, জানলার ফুটোয় চোখ লাগিয়ে আছে, জানুক এ ষড়যন্ত্রকারীদের ছড়ান গুজব মিথ্যা।’
‘আর যদি বিদ্রোহীরা কোন ফাঁকফোকর দিয়ে তীর ছোঁড়ে?’
‘সাহস করবে না। শাহজাদার তাই ইচ্ছে, আগে আগে যাওয়া। আল্লাহ্ রক্ষা করবেন ওঁকে।’
বাবরের নেতৃত্বে অশ্বারোহীদল এগিয়ে গেল দুর্গতোরণের দিকে। প্রধান ফটক খুলে গেল, খাজা আবদুল্লাহ, কাসেম বেগ, শাহী সিপাহসালারা সবাই বেরিয়ে এল বাবরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। ঘোড়া থেকে নেমে বাবর তার শিক্ষককে অভিবাদন করলেন। তার তরুণ প্রাণ ভেঙ্গে যেতে লাগল, চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। খাজা আবদুল্লাহ তাকে বুকে চেপে ধরলেন, একটু আদর, ভরসা দিতে হবে ছেলেটিকে। হ্যাঁ ছেলেই তো! আর অবশ্যই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। বেগরা, নোকররা দেখছে খাজা আবদুল্লাহর চোখে জল, কিন’ দ্রুত আত্মসংবরণ করলেন তিনি।
‘আমাদের দুঃখের শেষ নেই,’ শাহজাদা, নিজেকে সংযত করে বললেন তিনি, ‘এখন আমাদের আশা ভরসা আপনিই।’
বেগদের মধ্যে একজন দু’পা এগিয়ে এল। খাজা আবদুল্লাহর কথার মাঝেই জোরে বলে উঠলো, ‘শাহজাদা, আমরা সব বেগরা আপনার সেবার জন্য প্রস্থত।’
বাবর যখন উত্তর দিলেন তখনও গলা কাঁপছে তার, ‘আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
ঐ সময় যখন সবাই একসঙ্গে তোরণদ্বার দিয়ে ভেতরে আসছে ইয়াকুব বেগও এসে যোগ দির বেগদের দলে। বাবরের ফিরে আসার খবর পেয়েই ছুটে এসেছে যাতে তার ওপর কোন সন্দেহ না পড়ে তার জন্য।
আগে যখন আন্দিজানে রাজধানী ছিল, সিংহাসনে ছিল শীতকালীন প্রাসাদে, সেটিই ছিল রাজধানীর প্রাণবিন্দু। কিন’ রাজধানী যখন আখসিতে স্থানান্তরিত হল, মর্মর পাথরের সোপনশ্রেণী সোনার জলের নকশায় অলঙ্কৃত এই প্রাসাদটি তার মহিমা হারায়। এখন বাবরের আগমন উপলক্ষে খাজা আবদুল্লাহর আদেশে সেই সোপানশ্রেণীর ওপর বিছান হয়েছে দামী গালিচা, যে উঁচু মঞ্চের ওপর আগে শোভা পেত সিংহাসন, সেটিও ঢেকে দেওয়া হয়েছে দামী তুর্কমেনী গালিচা দিয়ে, সভাকক্ষের চারদিকে পেতে দেওয়া হয়েছে নরম গদী।
বেগুনী রংয়ের গালিচার ওপর দিয়ে যেতে যেতে কেশে উঠলেন বাবর: গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। নিঃশ্বাস ফেলারও সময় হল না- বাদশাহের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলেন- মঞ্চের উপর উঠে বসলেন।
সবাই বসলেন। খাজা আবদুল্লাহ মরহুম বাদশাদ মির্জা ওমর শেখের উদ্দেশ্যে ফতেহা পাঠ করলেন, ‘হে আল্লাহ্, ওঁকে বেহশ্ত নসিব করুন। আমিন!’ সমস্বরে বলে উঠল সব বেগরা। বাবরের দিকে ফেরান মুখগুলিতে ফুটে উঠেছে সমবেদনা আর বিষাদ।
‘খুদাবন্দ হুকুমতের সুযোগ্য ব্যক্তিরা।’ আরম্ভ করলেন খাজা আবদুল্লাহ। ‘যুদ্ধের এই জরুরী পরিসি’তি না হলে আমরা শোকপালন অনুষ্ঠান উপযুক্তভাবেই করতাম। আখাসিতে তার দাফন হয়েছে সসম্মানে। কিন’ এখন আন্দিজানের দুয়ারে শত্রু, আমাদের ওপর অনেক দায়িত্ব। সর্বপ্রথম দায়িত্ব সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর হাতে অবিলম্বে রাজ্যভার তুলে দেওয়া, আমাদের নতুন বাদশাহের হাতে…’
ইয়াকুব বেগ অন্য সবার আগেই সে কথার খেই ধরে বললো, ‘আপনি উপযুক্ত পন’ার কথাই বলেছেন পীরসাহেব। এখনি আমাদের মির্জা জাহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবরকে ফরগানার বিধিসঙ্গত বাদশাহ বলে ঘোষণা করা উচিত।’
বাবর তাড়াতাড়ি দেখে নিলেন ইয়াকুব বেগকে। স্বরে কোমলতা ও আনুগত্য; মুখেও তার ছাপ। এমনকি তার ফোকলা মুখের হাসিও তৃষ্ণায় কাতর তরুণের পছন্দ হলো। সবাই জানে যে ইয়াকুব বেগ মোগল বেগদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। উদ্ধত বাবরের গোপন স্বপ্নগুলির মধ্যে একটি ছিল, কোন একদিন পিতার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়ে সমস্ত বেগদের নেতৃত্ব করা আর সত্যিকারের ইমানদার, যোদ্ধা ও পুরুষমানুষের মতই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করার জন্য বেগদের পরিচালনা করা। এখন- পিতা নেই, ধূর্ত ইয়াকুব তার এই শোকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। মোগলের পরে বিভিন্ন বংশের অন্যান্য বেগরা একে একে বাবরকে ফরগানার শাসক বলে অভিহিত করলেন, তার স্বপ্ন যেন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা পূর্ণচন্দ্রের মত নেমে আসা বিপদ, শারীরিক যন্ত্রণা সব যেন কোন দূরে পড়ে রইল- হ্যাঁ, বাবর হবেন প্রতিপত্তিশালী শাসক, যার হুকুম বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেবে হাজার হাজার লোক।
নিজেকে সেনানায়ক বলে ভাবতে ভালবাসতেন তিনি। ঠিক তার পূর্বপুরুষ আমির তৈমুরের মতো। বাবর তার নিষ্ঠুরতার কথা শুনেছেন, তার পুনরাবৃত্তি তিনি চান না। মানুষের স্মৃতিতে ক্ষত না রেখে, রাখতে হবে তার যুদ্ধক্ষমতায় লোকের মনে বিস্ময়! পূর্বপুরুষের নিষ্ঠুরতা তাকে আকর্ষণ করতো না, আকর্ষণ করতো চমৎকার যুদ্ধজয়, তার প্রচন্ড শক্তি, নাম-প্রতিপত্তি, যা স্বেচ্ছাচারী বেগদের বুকে কাঁপন ধরাতো।
ব্যস্তভাবে কুর্ণিশ করতে করতে এসে ঢুকল উজুন হাসান, ‘শাহজাদা, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে আসতে পারি নি বলে আপনার গোলামকে মাফ করবেন। যারা আন্দিজানে মিথ্যা আর নোংরা গুজব ছড়াচ্ছে সেই সব ষড়যন্ত্রকারীদের ধরায় ব্যস্ত ছিলাম, এই যে তাদের একজনকে ধরে নিয়ে এনেছি।’
শিউরে উঠলেন বাবর, ‘মাথা? কে সে? নিয়ে আসুন তাকে।’
সবার দৃষ্টি ঘুরল দরজার দিকে। ইয়াকুব বেগের মুখ রক্তহীন হয়ে গেল। আহমদ তনবাল ধরা পড়ল নাকি? তা হ’লে সব গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাবে। দিশেহারা চোখদুটো বুলালো চারদিকের দেয়ালে। জানালা খুবই কম এখানে আর মোটা দেহ নিয়ে সে বসে আছে জানলা থেকে অনেক দূরে। নাঃ, পালিয়ে বাঁচা যাবে না এখান থেকে।
এমন সময় দরজার বাইরে ভারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আমার হাত খুলে দিন, আমার কোন দোষ নেই।’
আল্লাহর রহমত। ইয়াকুব বেগ মনে মনে খুশী হয়ে উঠল, আহমদ তনবালের গলার আওয়াজ নয় এটা।
দু’জন অনুচর সাদা লম্বা পোশাক পরা স্থূল, দীর্ঘকার এক ব্যক্তিকে ভিতরে নিয়ে এলো।
‘আরে এ যে, দরবেশ গোব্,’ বিস্ময় ধ্বনি করে উঠল ইয়াকুব বেগ, তার পরে আরো অনেক বেগও।
এই লোকটি হল আন্দিজানের সেচব্যবস্থার তদারককারী, নিজের চওড়া ঘাড়টা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ষাঁড়ের মত, তাই তার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘গোব্’ অর্থাৎ ষাঁড়। আর সর্বদা গরীবদের সাহায্য করার জন্য তাকে দরবেশ বলে ডাকা হতো, আল্লাহ্ ওদের ওপর মেহেরবান, বলতো গোব্। যদিও নয়টি জলবহা নালী দিয়ে জল সরবরাহ করা হতো আন্দিজান কেল্লায়, কিন’ গ্রীষ্মকালে বহুসংখ্যক বাগানে জল দেবার ফলে জলের অভাব হতো। বেগরা চেষ্টা করতো জল নেবার সারি থেকে গরীবদের বিতাড়িত করার। কিন’ দরবেশ গোব সাহস করে গরিবদের পক্ষ নিয়ে দাঁড়াতো। তুমি বেগ, নিজের কাছে নিজে বেগ, কিন’ খোদার কাছে সবাই সমান! সাধারণ লোকেরা অবশ্যই তার কথায় সায় দিতো। তাই বেগদের প্রচন্ড রাগ তার ওপর। বিশেষত উজুন হাসান বহুদিন রাগ পুষে রেখেছিল তার ওপর।
দরবেশ গোব্ পিছনদিকে হাত বাঁধা অবস্থায় নীচু হয়ে অভিবাদন করল প্রথমে বাবরকে, তারপর একটু দূরে বসা খাজা আবদুল্লাহকে।
‘ন্যায়বিচার করুন শাহজাদা!’ আত্মমর্যাদার সঙ্গে বলল সে। ‘আমি ষড়যন্ত্রকারী নই, পীরসাহেব।… বাজারে একজন লোক বলল আমায় আখ্সিতে শাহ্ মাতাল অবস্থায় নদীর খাড়া পাড় থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। আর মির্জা বাবর শত্রুর ভয়ে আলাতাউ পালিয়ে গেছেন।’
এ অপবাদ। বারুদের মত জ্বলে উঠলেন বাবর।
‘এটা যে রটনা তা জানি হুজুর। লোকটির কাছে যা শুনেছি কাউকে বলি নি আমি। দয়া করুন শাহজাদা।’ দরবেশ গোব্ দু’তিন পা এগিয়ে গিয়ে নতজানু হল। ‘আমি জানি, আমি জোর দিয়ে বলেছি যে এ রটনা। আপনার চোখেমুখে এমন আভিজাত্য ভীরুতার কোন ছাপ নেই আপনার মুখে। বাজারে যখন সবাই দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করে দিল, দোকানপাট বন্ধ করে দিতে লাগল, শপথ করে বলছি, কেমন দিশাহারা হয়ে গেলাম। আমি গুজব ছড়াই নি, আমি কেবল একজন লোককে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, শুনেছ যেসব কথা বলাবলি হচ্ছে। সে বলল, শুনেছে। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, এ সব সত্যি নাকি। এমন সময়ই কোতোয়ালের চররা এসে ধরলে আমায়…’
‘না, না, তুই মিথ্যা বলছিস। বলতে চাস, স্রেফ জিজ্ঞাসা করেছিলি। তুই গুজব ছড়াচ্ছিলি আর সেই কারণেই ধরা পড়েছিস।’ বলে উঠলো উজুন হাসান।
‘কোরান শরীফ দিন আমায়, কোরান শরীফের কসম নিয়ে বলব আমি!’
‘আরে, অপরাধ করে আবার কোরান চায়?’ বাবরের দিকে বিরক্তিভরা মুখ ফিরিয়ে বলল ইয়াকুব বেগ। ‘শাহজাদা, এই হতভাগা যদি আপনার অনুগত হতো, তবে যে লোকটির কাছে ঐ গুজব শুনেছে তাকে ধরে কোতোয়ালের হাতে তুলে দিতো।’
এর উত্তরে দরবেশ কেবল বলল,’হায় খোদা।’
ইয়াকুব বেগ আবার কোমল দৃষ্টিতে চাইল বাবরের দিকে, ফোকলা মুখে বাঁকা হাসি হেসে বললো, শাহজাদা আপনার ওয়ালিদ সাহেব গোব্কে ভেরীর সর্দার করেছিলেন, ভেরীর সর্দার হয়েছিল আপনার ওয়ালিদ সাহেবের মেহেরবানীতে, আবারও বলি… আরও এখন গুজব ছড়াচ্ছে… আমাদের মরহুম বাদশাহ, খোদা তার জান্নাত নসীব করুন… মাতাল অবস্থায় পড়ে গেছেন নদীর পাড় থেকে। কি স্পর্ধা!
শিশুকে প্রতারণা করবো না তো কাকে করবো, ভাবলো ইয়াকুব বেগ রাগে অপমানে বাবরের চোখে কেমন আগুন জ্বলে উঠল তা দেখে।
ওই তো স্বীকার করে ফেলল যে যা শুনেছে তা অন্যকে বলেছে। আবার জিজ্ঞাসা করেছে, তার মানেই অন্যকে বলেছে! আসলে কোন তফাৎই নেই! বললো মজিদ বেগ।
জিভের জন্য ধরা পড়েছে- শাসি- পাওয়াই উচিত! আলী দোস্ত বেগও অভিযোগকারীদের পক্ষ নিল।
কেন কে জানে কাসিম বেগের মনে পড়ল সেই অদ্ভুত পায়রাটির কথা যেটি বাবরের মামাকে বাদশাহের মৃত্যুর খবর এসে দিয়েছিল।
মনে হয়, আরো তদনে-র প্রয়োজন, কী বলেন? জিজ্ঞাসা করল কাসেম বেগ।
মজিদ প্রতিবাদ করলো, ‘দীর্ঘ তদনে-র সময় কোথায়? দুয়ারে শত্রু এসে পৌঁছেছে, পীর বললেন তো। আর রক্তাক্ত যুদ্ধের সময় সে আতঙ্ক ছড়ায়, শাসকের মর্যাদাহানি করে- সেও শত্রু। ওকে দয়া দেখানো উচিত নয়!’
‘অন্যরা যাতে ভয় পায় সে জন্য একে শহরের চত্বরে নিয়ে গিয়ে শাসি- দেওয়া উচিত। যাতে অন্যরা শিক্ষা পায়,’ বলল উজুন হাসান।
‘চত্বরে শাসি- দেওয়া’ মানে মাথা কেটে ফেলা।
গোবের মুখে মৃত্যুর ছায়া দেখা দিল। হাঁটু গেড়ে বাবরের কাছে আরো এগিয়ে গেল সে, বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো তার।
‘শাহজাদা, আমি অপরাধী নই। আমি অপরাধীদের শিকার হয়েছি। দয়া করুন আমায়। পাঁচটি বাচ্চা আমার। তাদের ভরসা কেড়ে নেবেন না, শাহজাদা!’ গোবের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা বলে চোখের জল অবাধে গড়িয়ে পড়ছে দাড়িতে।
বয়স্ক পুরুষমানুষের এমনি কান্না বাবরের রাগ নিভিয়ে দিল এক মুহূর্তে। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তিনি তাকালেন খাজা আবদুল্লাহর দিকে। হঠাৎ তার ভীষণ ইচ্ছে হল কেউ বলুক, বেচারাকে দয়া করুন। কিন’ খাজা আবদুল্লাহ চুপ করে আছেন। বেগরা কিন’ চুপ করে নেই।
‘যার পাঁচটি বাচ্চা, তার জবান সামলানো উচিত ছিলো।’ নিষ্ঠুর হাসি হাসলো ইয়াকুব বেগ।
‘আরে এ গোব একটা পাক ষড়যন্ত্রকারী,’ হাত নাড়িয়ে বললো উজুন হাসান, ‘যে ওকে বলেছে যে বাদশাহ্ মাতাল ছিলেন এবং নিজের দোষেই মারা গেছেন তার মুখে একটা মেরে দিতে পারতো… বা আমাদের হাতে তুলে দিতে পারতো।’
দরবেশ গোবের মিনতি এই সব হুমকিতে ডুবে যাচ্ছিল।
‘শাহজাদা, ন্যায়বিচার করুন! আপনার ওয়ালিদ সাহেবের বিশ্বস্ত লোক আমি! এই বেগদের জানেন না আপনি। ওরা আমার ওপর বদলা নিচ্ছে! বেগদের বিশ্বাস করবেন না, শাহজাদা। অন্যদের জিজ্ঞাসা করুন। সব ইমানদার লোক আমায় জানে।’
আলী দোস্ত বেগ জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, ‘কী বেগরা বেইমান? শুনেছেন, বাদশাহ্, দেখছেন কেমন পাপী মন এই দরবেশের?’
ইয়াকুব বেগ বাবরকে কুর্ণিশ করে গুনগুন করে বললো, ‘এই গোব্টা বেগদের বিরুদ্ধে নীচতলার সব লোককে লাগানোর তালে আছে হুজুর।’
‘অত্যন্ত নীচ মতলব ওর!’, চীৎকার করে বলল উজুন হাসান। তারপর অনুচরদের বললো, ‘হয়েছে! একে নিয়ে যাও এবার!’
প্রহরীরা ছুটে এসে গোব্কে মাটি থেকে টেনে তুলে ধাক্কা দিতে দিতে আর মারতে মারতে দরজার দিকে নিয়ে গেল। গোব্ তখনও চেঁচাচ্ছে, ‘আমি অপরাধী নই। আমার বাচ্চাদের চোখের জল তোমাদের লাগবে, বেগ! আমার বেকসুর খুনই তোমাদের খতম করবে।’
এই অভিশাপ বাবরের হৃদয়ে বিঁধল তরোয়ালের খোঁচার মতই! হঠাৎ আবার তার মনে পড়লো সেই নিশ্চিন্ত সকালের কথা যখন তিনি তার সমবয়স্কদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াচ্ছিলেন। এ সবই তো সত্যি! আলি শের নবাইয়ের ছবি দেখতে দেখতে মধুর স্বপ্নে ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। মনে হচ্ছে যেন সেই থেকে কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে… হ্যাঁ আজ সকালে, আজ দুপুরের আগে পর্যন্ত তার জীবন ছিল রৌদ্রদীপ্ত আকাশের মতই পরিষ্কার। এই কালো মেঘগুলো যে কোথা থেকে এল? প্রতিটি রক্তপিপাসু বেগ দরবেশ গোবের মাথা কেটে ফেলার দাবী জানাচ্ছে, প্রত্যেকে তারা যেন এক একটা ঝড়ো মেঘ, বাবরকে সূর্যকে ঢেকে ফেলতে চাইছে। ঘুর্ণিঝড় নিষ্ঠুর, ক্রদ্ধ হাওয়া ও ঘূর্ণিঝড়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আর সেই ভয়ঙ্কর অনুভূতি, যে প্রতিপত্তি ও সিংহাসন দরবেশ গোবের মত এমন লোকেদের রক্ত দাবী করে, তার বুকে আঁচড় কাটতে লাগল।
কানে আসতে লাগলো চীৎকার, ‘এই লোকটার মাথা কেটে ফেলা হোক?’
‘মাথা কেটে ফেলা হোক!…’ রাজনীতি দাবী করছে, রাজনীতি।
বাবর কুয়াশার মধ্যে দিয়ে তখনও যেন দেখতে পাচ্ছেন গোবের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে সাদা দাড়িতে। এই লোকটি , জীবিত, এমনি চেহারা, পরিণত হবে মৃতদেহে? আর বাবরকে অনুমতি দিতে হবে তাকে মেরে ফেলার? কিন’ কেন? কারণ বেগরা তাই চায় বলে?
আসলে, হয়তো বেগরাই তাকে, বাবরকে প্রতারণা করছে? হয়তো এমন ধরনের বেগরাই আখসিতে পিতাকে নদীর খাড়াপাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে? কাল অথবা পরশু বাবরের জীবনের ওপরও আঘাত হানবে?
‘ওস্তাদজি!’ রুদ্ধকণ্ঠে খাজা আবদুল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন বাবর।
খাজা আবদুল্লা ঝুঁকে পড়লেন বাবরের কাঁধের কাছে, ‘শক্ত হতে হবে, শাহজাদা।’
‘কী করবো, বলে দিন।’ ফিসফিসিয়ে বললেন বাবর।
‘দন্ড ঘোষণা করতে হবে। বেগরা দাবী করছে মৃত্যুদন্ড।’
‘আর আপনি মওলানা? ‘
‘যখন আন্দিজানের আর গোটা ফরগানার ভাগ্য নিয়ে জুয়া খেলা হচ্ছে, তখন কোন এক গোবকে নিয়ে মাথা ঘামালে চলে?’
‘শাহজাদা,’ খাজা আবদুল্লাহ এবার ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘এই বিপদের মুহূর্তে বেগদের বিরোধিতা করা যায় না। আদেশ দিন… মৃত্যুদন্ডের…’
পরের দিন কেল্লার প্রবেশপথের সামনের চত্বরে ঢাকঢোলের আওয়াজের মাঝে দরবেশ গোবের মাথা কাটা পড়ল। আর সেইদিনই অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে আহমদ তনবাল সবার অলক্ষ্যে আখসি রওনা দিল।