১
উঁচু টিলার ওপর তৈরী করা আখ্সির কেল্লা রাতের অন্ধকারে কালো পাহাড়চূড়ার মত দেখাচ্ছে। টিলার পায়ের তলাতেই কাসানসাই নদী এসে মিলেছে সির-দরিয়ার সঙ্গে- দূরে থেকেই শোনা যায় দুই পাহাড়ী খরস্রোতা নদীর ঢেউগুলি পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে আর তীরে ধাক্কা দিয়ে ফাঁপা আওয়াজ তুলছে।
ফরগানার শাসক আর আখ্সি কেল্লার অধিপতি মির্জা ওমর শেখ আজকের রাত কাটিয়েছেন হারেমে আঠারো বছরের কারাকুজ বেগমের কক্ষে।
ভোর হবার অল্প আগে কেল্লার নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল সানাইয়ের নীচু বিলাপসুরে। তারপর দুটি ঢাকের আওয়াজ যোগ দিল তার সঙ্গে। রোজা রাখা প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ। বাদশাহ বা গোলাম প্রত্যেককেই তাই শুনতে পায় সেহরীর সময় নির্ধারণী এই সানাই আর ঢাকের আওয়াজ। গ্রীষ্মের রাত খুব বেশি দীর্ঘ নয়। ভোরের আগে ঘুম থেকে ওঠা কষ্টকর। কিন’ সেহরী করতেই হবে।
কারাকুজ বেগম সাবধানে নেমে এলো পালঙ্ক থেকে। ওমর শেখের পা দুটি বেরিয়ে আছে রেশমী চাদরের নীচে থেকে। এক অতি সুন্দর ও বিশাল ঘরে ওমর শেখের জন্য অপেক্ষা করছে প্রচুর খাবারে সাজানো নীচু মেজ্। গতকাল ইফতারের পরে শাহ্ বলেছিলেন আজকের সেহরীর সময়ে তার তিন স্ত্রী এবং পুত্রকন্যারা সবাই যেন থাকে। মির্জার বড় বেগম ফাতেমা-সুলতানা, দ্বিতীয় কুতলুগ নিগার-খানম, মির্জার সতেরো বছর বয়সের কন্যা খানজাদা বেগম এবং দশ বছরের পুত্র জাহাঙ্গীরও ইতিমধ্যেই এসেছে। কিন’ যতক্ষণ না বাদশাহ্ নিজে আসবেন, খাবার মুখে না দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ খাবারে হাত ছোঁয়াবে না।
ভোজনকক্ষ থেকে অন্দরমহলে শয়নকক্ষের দিকে যাবার নকশা কাটা দরজাটা খুলে গেল – বেরিয়ে এল তন্বী, সুন্দরী, অনতিদীর্ঘাকৃতি কারাকুজ বেগম। সসঙ্কোচে অভিবাদন জানাল জ্যেষ্ঠা দুই স্ত্রীকে, বলল বাদশাহ্র ঘুম ভাঙাতে সাহস হচ্ছে না তার। কারাকুজ বেগমের যৌবন, দ্যুতিময় সৌন্দর্য আর লাজুকভাব (লাজুক ভাব? কে না জানে যে এই কচি মেয়েটিই এখন মির্জার প্রিয়তমা) মুহূর্তে ফাতেমা-সুলতানের ঈর্ষাবোধকে জাগিয়ে তুললো, ‘আপনি আমাদের বাদশাহ্কে এমন গভীর ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন আর এখন সে ঘুম ভাঙাতে সাহস হচ্ছে না আপনার?’
কুতলুগ নিগার-খানমের ভাল লাগল না এই খোঁচা দেওয়টা। অমন করে বলার দরকার কী? তাও মেয়ের সামনে। ‘কারাকুজ বেগমের কোন দোষ নেই।’ বলল সে।
খানজাদা বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মা’র দিকে, সব দোষই কি তার আব্বাজানের? বাবার আচার-ব্যবহার অত্যন্ত অদ্ভুত ঠিকই, যুদ্ধের বিপদাশঙ্কায় সবাই উৎকণ্ঠিত, আখসির দুয়ারে দুশমন হানা দিয়েছে, আর তিনি কিনা স্বসি-তে ঘুমাচ্ছেন! … আর কত সময় কাটান হারেমে। কারাকুজ প্রায় তারই সমবয়সী। ভাবলে লজ্জা হয়। খানজাদা বুঝলো বাবা যখন এখানে আসবেন সে তখন তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।
‘আমায় অনুমতি দিন, ওয়ালেদা সাহেবা, আমি যাই…. সেহরীর সময় হয়ে গেছে… আমি আমার সখীদের সঙ্গে…’
‘যদি তোমাদের আব্বা জিজ্ঞাসা করেন খানজাদা বেগম কোথায়, কী উত্তর দেব আমরা? ওঁর মনে আঘাত দেওয়া হবে তাতে। অপেক্ষা করো মা…. ব্যস্ত হয়ো না।’
পরিবেশিকা ভিতরে এসে নীচু হয়ে কুর্ণিশ করে জানালো, আকাশের তারা মিলিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে। একটু বাদেই ভোর হবে। বাদশাহ্ কি সেহরী করবেন না তাহলে?
সারাদিনে এক টুকরো খাবার বা এক ফোঁটা জলও খাবেন না? গ্রীষ্মের এই দীর্ঘ কষ্টকর দিনে স্বামীকে আহার্য-পানীয় থেকে বঞ্চিত রাখা প্রকৃত স্ত্রীর পক্ষে নিজে আহার্য-পানীয় থেকে বঞ্চিত থাকার চেয়েও ভয়ঙ্কর, কিন’ স্ত্রীদের মধ্যে কে তার ঘুম ভাঙাবে?
একমাত্র কারাকুজ বেগমই তা পারে। তার সাথেই রাত কাটিয়েছেন মির্জা, গভীর ঘুমে অচেতন। তার কাছে যাবার অধিকার যার, সে-ই দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে নচ্ছার ছুঁড়িটা, ভাবলো ফাতেমা-সুলতান। ভয় পাচ্ছে বেচারী, ভাবলো কুতলুগ নিগার-খানম। পরিবেশিকা চোখে মিনতি ফুটিয়ে তাকালো কারাকুজ বেগমের দিকে, বললো, ‘খোদা আপনাকে রুস্তমের মতই শক্তিশালী পুত্র দেবেন, বেগম সাহেবা… আপনিই আমাদের আশা ভরসা।’
মুখের করুণ ভাবের পরিবর্তে দুশ্চিন্তায় পড়লো কারাকুজ বেগম, ধীরে ধীরে পিছন ফিরে শয়নকক্ষে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে।
মির্জা ওমর শেখ তখনও গভীর ঘুমে অচেতন। সোনার প্রদীপদানটা হাতে তুলে নিয়ে বেগম পর্দার আড়ালে গেলেন, দেয়ালের কুলুঙ্গীতে রাখলেন প্রদীপটা। প্রদীপের আলো সোজা এসে পড়েছে মির্জার মুখে। কিন’ তাতেও তার ঘুম ভাঙ্গছে না- গতকাল সন্ধ্যায় ওমর শেখ মাগজুন খান, তাতে অল্প আফিম মেশান হয়। ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেলার ভয়ে কারাকুজ বেগম নরম স্বরে কিন’ বেশ জোর দিয়ে বললেন, ‘মালিক… হুজুর.. জাগুন।’
পালঙ্কের কাছে নতজানু হয়ে বলল সে, কাঁপা কাঁপা কোমল হাত রাখল বাদশাহের চওড়া হাতের ওপর, উদ্বেগে দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। বিছানায় গোলাপের গন্ধ, কাল সন্ধ্যায় বিছানায় ছড়ান হয়েছে গোলাপের নির্যাস। এমন গভীর ঘুম দেখে কারাকুজ বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্বামীর মুখের দিকে। মুখ অল্প ফাঁক হয়ে আছে, পান্ডুর মুখমন্ডলে শানি-র ছোঁয়া। বদরাগী বাদশাহ্? না, না, সুন্দর, শক্তিমান পুরুষ, বয়স চল্লিশ ছোঁয় নি এখনও। তার স্বামী, তার মালিক, মহাবীর, তার ঘুমও মহাবীরের উপযুক্তই। প্রিয়তম!
গতরাতের সুখানন্দের কথা মনে পড়ে তার সমস্ত নারীসত্তা লজ্জায় রাঙিয়ে উঠলো। আর তখনই তার মনে হল প্রেম যেন কেমন . . . স্বল্পস্থায়ী একটা কিছু। শত্রুসেনা এগিয়ে আসছে এখন আখসির দিকে, কে জানে কাল তাদের কি হবে? কারাকুজ বেগমের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো- যেন মৃত্যু খুব কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে এমন এক অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি ঝুঁকে পড়ে মির্জাকে চুম্বন করতে লাগল, চোখে, মুখে, হাতে।
কেঁপে উঠল ওমর শেখ, ঘুম ভেঙ্গে বিছানায় উঠে বসল, কয়েক মুহূর্তে তন্দ্রাজড়িত চোখে চেয়ে রইল কারাকুজ বেগমের দিকে, যেন তাকে চিনতে চেষ্টা করছে। কারাকুজ বেগমের বড় বড় চোখগুলি ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল। ঘুমন্ত স্বামীকে চুম্বন করেছে সে ঘুম ভাঙাবার জন্য! উনি সেটাকে অসম্মান বলে ভাবলেন না তো?
‘তুমি?’ বলে আড়ামোড়া ভাঙলেন মির্জা, তারপর স্ত্রীর ভয়ের কারণ বুঝতে পেরে হেসে ফেললেন। স্বসি-র নিঃশ্বাস ফেলল কারাকুজ বেগম।
‘মালিক সেহরীর সময় শেষ হতে চললো।’
‘তোমার চুম্বন সব মিষ্টি খাবারের চেয়েও মিষ্টি। এদিকে এসো….’
‘ওদিকে, সবাই আপনার অপেক্ষায় আছে।’ হাতের ইঙ্গিতে দরজার দিকে দেখিয়ে বললো কারাকুজ বেগম।
মির্জা ওমর শেখ এবার পুরোপুরি জেগে উঠলেন। আজকের দায়িত্বের কথা মনে পড়লো তার। ভুরু কুঁচকে উঠল তার, স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে কোন কথা না বলে নামলেন বিছানা থেকে।
জরি বসান নরম গালিচা বিছান ভোজনকক্ষে এসে ঢুকলেন তিনি প্রধান দরজা দিয়ে, সুন্দর পোশাক পরিহিত, গম্ভীর, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের জন্য প্রস্থত। দামী মুক্তাবসান উষ্ণীষ ও জরিবসান কোমরবন্ধে তাকে আরো গম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ দেখাচ্ছে। বরাবরের মতই সবাই কুর্ণিশ জানাল, মেয়েরা চুপ রইল বাদশাহের আমন্ত্রণের প্রতীক্ষায়। কোন্ স্ত্রীকে কোন্ জায়গায় বসতে ডাকবেন উনি?
তিনদিক থেকে শত্রু এগিয়ে আসছে ফরগানা উপত্যকার দিকে; আখসি কেল্লার অবরোধ হবার আশঙ্কা আছে। মির্জা ওমর শেখ ঠিক করলেন তার স্ত্রীদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে দেবার, প্রত্যেকের প্রতিই যথাযোগ্য মনোযোগ দেবার। প্রথম ও সবার চেয়ে দাম্ভিক স্ত্রী ফাতেমা-সুলতান, তাকে মির্জা ডাকলেন নিজের পাশে বসতে। ফাতেমার চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ওমর শেখের ডানদিকে বসবে ভেবেছিল সে, কিন’ মির্জা তাকে বাঁদিকে জায়গা দেখিয়ে দিলেন। আর নিজের ডানদিকে সবচেয়ে বেশী সম্মানের জায়াগায় বসতে আমন্ত্রণ জানালেন কুতলুগ নিগার-খানমকে। সেও অকারণে নয়, সিংহানের উত্তরাধিকারী জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের জন্মদাত্রী তিনি। রাগে চোখ কুঁচকে গেল ফাতেমা-সুলতানের।
হরিণের মাংসের কাবাব, পাখীর মাংস ভাজা ও অন্যান্য খাবার ওমর শেখের পরে এগিয়ে দেয়া হলো কুতলুগ নিগারের দিকে, তারপরই ফাতেমার পালা। টাটকা, নরম মাংস মুখের মধ্যে গলে যেতে থাকলেও ফাতেমার বিস্বাদ লাগছিল- মনে হচ্ছিল যেন দ্বিতীয়বার গরম করে আনা হয়েছে।
সাদা হয়ে আসছে আকাশ। ভোরের আলো যত ফুটে উঠছে প্রদীপের আলোও ততই ম্লান হয়ে আসছে। আজানের সময় হয়ে গেছে। মসজিদের ইমাম মিনারের ওপর উঠে বাদশাহের রন্ধনশালার তত্ত্বাবধানকারীর ইঙ্গিতের অপেক্ষায় আছে, বাদশাহের সেহরী শেষ না হওয়া পর্যন্ত আজান আরম্ভ না করাই ভাল।
খাওয়া হয়ে গেলে চা পরিবেশন করা হলো। চা পান করতে করতে মির্জা স্ত্রীদের বলতে পারতেন সরকারী কাজকর্ম কেমন তালগোল পাকিয়ে গেছে। কিন’ ওমর শেখ বলতে আরম্ভ করার আগেই আজানধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল। খানজাদা বেগম চায়ে চুমুক না দিয়েই পেয়ালা নামিয়ে রাখলেন তাড়াতাড়ি।
‘শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মিলে-মিশে থাকা উচিত, এই হল দানিশমন্দদের উপদেশ। ফাতেমা-সুলতান, কুতলুগ নিগার-খানম, কারাকুজ বেগম আর আমার সন্তানেরা, খানজাদা আর জাহাঙ্গীর’, নাম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকালেন মির্জা, ‘আমরা প্রত্যেকে একই পরিবারের অঙ্গ। আমি চাই এই বিপদের দিনে তোমরা একে অন্যকে শ্রদ্ধা করবে, সাহায্য করবে। হাতের নির্দিষ্ট মূল্য আছে তার নিজের জায়গায়, চোখেরও মূল্য আছে নিজের জায়গায়, হাত বা চোখ যদি পরস্পরের কোন ক্ষতি করে তো সে ক্ষতি হবে সারা শরীরেই আর তার ফলও ভোগ করতে হবে।’
সবাই বুঝলো দুটি তীর কাদের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া হলো। ফাতেমা-সুলতানের চোখ দুটি আরো সরু হয়ে গেল। কুতলুগ নিগার-খানমের মাথায় তখুনি খেলে গেল একমাত্র পুত্র বাবরের কথা, যে আছে দুরে- আন্দিজানে। মালিক তার নাম করলেন না কেন?
‘মালিকের কথা মুক্তার চেয়ে মূল্যবান!’ বলল সে। তারপর যোগ দিল, ‘অনুমতি পেলে একটা প্রশ্ন করি…’ মাথা নাড়িয়ে অনুমতি দিলেন ওমর শেখ।
‘যুদ্ধের আশংকা দেখছি বেশ ভয়ানক, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মির্জা বাবরের জন্য ভয় হচ্ছে, সে এখন আমাদের কাছে থাকলে কোন ভয় ছিল না…’
‘আন্দিজানের কেল্লা মজবুত। আর মির্জা বাবর সেখানে থাকলে তা দুর্ভেদ্য। তার ওপর আমার অনেক আশা।’
খানমের অনুরোধ রাখালেন না মির্জা। ফাতেমা-সুলতান নিজের ছেলেকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। দেখুক শিয়ালী কে তাদের মধ্যে বেশী সুখী, তার ছেলে অন্তত মায়ের কাছে আছে, আর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী…
‘মির্জা বাবরের মা মালিককে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে, উত্তরাধিকারী-পুত্রের উদ্দেশ্যে এত প্রশংসাবাক্য বলার জন্য’ বলে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল নিগার-খানম। ‘কিন’ …. এ কী করে হয়? ঐটুকু ছেলে এখনও বারো বছর পার হয়নি… লড়াইয়ের ময়দানে…’
‘চিন্তা করার কোন কারণ নেই খানম। মির্জা বাবরের কাছে রাখা হয়েছে আমাদের সবচেয়ে ভালো বেগদের। ওর বয়স কম, যুদ্ধবিদ্যা ওর শেখা উচিত এখনই। যদি আমার মুত্যু হয় আমার স্থান নেবে সিপাহসালার বাবর।’
বাদশাহের বয়স মাত্র উনচল্লিশ বছর। হঠাৎ তিনি মৃত্যুর কথা বললেন। হায়, এই যুদ্ধ। বিষণ্ন হয়ে গেল মেয়েরা। একটু আগে বাবর সম্বন্ধে তার যে কথা মনে হয়েছিল তা ভুলে গিয়ে খানজাদা বেগম করুণ মায়াভরা চোখে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। ওমর শেখ জোরে আর স্পষ্ট করে বলতে লাগলেন যাতে সবাই শুনতে পায় আর বুঝতে পারে, ‘যদি যুদ্ধের ফলে বা অন্য কোন আকস্মিক ঘটনায় আমি এই নশ্বর জগত ছেড়ে চলে যাই তবে তোমরা মির্জা বাবরের আদেশ মানবে আমার আদেশের মত করেই। মির্জা জাহাঙ্গীর। তুমি ঘুমোচ্ছ, নাকি?’
ছেলেটি চমকে উঠে সতর্ক হয়ে গেল, তারপর মুহূর্তে বুকে হাত রেখে বলল, ‘শুনছি, মালিক!…’
‘আমার এই কথাগুলো তুমিও মনে রাখবে। যদিও মির্জা বাবর তোমার থেকে মাত্র বছর দুয়েকের বড়, কিন’ যখন ও আমার জায়গায় আসবে তুমি হবে তার বিশ্বস্ত পুত্র।’
‘যা আদেশ হয়, মালিক।’
সে পিতার কথার গভীর আর গূঢ় অর্থ বুঝতে পারলো না, কিন’ কথা শোনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। প্রথম দুই স্ত্রী ভয় পেয়ে গেছে- যে যার নিজের চিন্তাধারা অনুযায়ী। কারাকুজ বেগমের চোখে (স্বামীর মুখের থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছিল না সে) চিকচিক করছে জল। তা দেখে ওমর শেখের মনে পড়ল আজ ভোরবেলায় তার যুবতী স্ত্রী তাকে চুমু দিয়েছিল, কিন’ সে কথা মনে পড়ে কেমন যেন আনন্দ হল না, তার মনে হল, সে চুম্বন করছিল- যেন মৃত স্বামীকে বিদায় জানাচ্ছিল। আর এখন তিনি যা বলছেন তাও যেন তার অনি-ম নির্দেশের মতো মনে হলো। ওমর শেখের বুকের মধ্যে কেমন যেন ধক করে উঠল সতর্কবাণীর মত। এ আমার হল কী? আজরাইল আসার খবর পেলাম নাকি? না, না!
খানজাদা বেগম লক্ষ্য করল পিতার এই বিহ্বলভাব। সাহায্য প্রয়োজন ওঁর, তার সাহায্যের প্রয়োজন, ‘মালিক, আপনার কন্যা দোয়া করছে আল্লাহ যেন আপনাকে শেখ সাদীর দীর্ঘ জীবন দেন! একশ’ বছর বাঁচুন আপনি!’
‘তোমার দোয়া পূরণ হোক, মা!’
মির্জা ওমর শেখ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন, যেন এই প্রথম বুঝলেন, কেমন বুদ্ধিমতী তার মেয়ে, কেমন সুন্দরী হয়ে উঠেছে সে। নিজের হাতে তোর বিয়ে দিতে চাই আমি প্রথমে।
এক সময় খানজাদার বিবাহের কথা উঠেছিল সমরখন্দের শাসকের পুত্র মির্জা বাইসুন কুরের সঙ্গে। কিন’ ওমর শেখ এখনও সে প্রস্তাবে পাকাপাকি সম্মতি দেন নি। আর এখন যখন সমরখন্দের সঙ্গে যুদ্ধ লাগল। পরিসি’তি যদি কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে অবশ্য বড় ভাইয়ের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন তিনি এবং এভাবে যুদ্ধকে শানি-তে পরিণত করবেন। খানজাদাও সেকথা বোঝে, তাই সেই সম্ভাবনায় সে আতংকিত। তার স্বপ্ন কিন’ অন্য। তাই সে আবার কথা ঘোরাল।
‘যদি আমার ভাই বাবরকে আখসিতে ডেকে পাঠানো সম্ভব না হয় তবে আমাকে আর মাকে আন্দিজান যাবার অনুমতি দিন।’ বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রস্তাব করল সে।
‘তুই আমার ধনসম্পত্তির অমূল্য মুক্তা রে, মা। এই বিপদের দিনে তোকে আমি দূরে পাঠাতে চাই না।’
‘তাহলে আমাকে একাই যেতে অনুমতি দিন মালিক!’ আবার কুতলুগ নিগর-খানম চনমন করে উঠলো।
‘আরে খানম, ব্যস্ত হবার কি আছে? মার্গিলান থেকে দূতের অপেক্ষায় আছি আমি। যখনই যাওয়া সম্ভব হবে অনুমতি পাবে….’
চটপট নামাজ সেরে নিয়ে উঠে পড়লেন ওমর শেখ, বেরিয়ে গেলেন হারেম থেকে। তখন মাথায় তার কেবল যুদ্ধের চিন্তা।
হারেমে প্রবেশের অধিকার না থাকায় তার দেহরক্ষীরা সারারাত বাইরেই অপেক্ষা করেছে। মালিকের চিন্তাধারায় ব্যাঘাত না ঘটাবার জন্য বা নিজেদের প্রতি মালিকে মনোযোগ আকর্ষণ না করার জন্য তারা নিঃশব্দে ও অলক্ষে মালিকের পিছু নিল।
২
ভোর হলো। সূর্য ওঠার আগেই সিপাহসালার, বেগ আর দরবারের আমীর-ওমরাহেরা সবাই এসে সমবেত হয়েছে। প্রধান উজীর বয়স ও পদমর্যাদা অনুযায়ী দামী জরির চাপকান এবং কোমরবন্ধ পরনে, সবার আগে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মির্জা তাকেই জিজ্ঞাসা করলেন কোথা থেকে দূত এসে পৌঁছেছে।
‘ইসফরা থেকে হুজুর।’ আবার নতজানু হয়ে মুখ আড়াল করে কুর্ণিশ করলেন।
‘কী খবর?’
‘গোলামের কসুর মাফ করবেন হুজুর…’
‘হুম…. তাহলে ইসফারও দুশমনের কব্জায় এসে গেল।’ ভেতরে ভেতরে কেমন এক অস্বসি-কর কাঁপুনি অনুভব করলেন ওমর শেখ, জিজ্ঞাসা করলেন মার্গিলানের দূতের কথা।
‘মার্গিলানের দূতের পথ চেয়ে আছি, মালিক।’
মার্গিলানও কি হার স্বীকার করবে? তাহলে আন্দিজানেরও রক্ষা থাকবে না। দূত আসছে না কেন? শত্রুর ফাঁদে পড়ল নাকি? নাকি মার্গিলানের বাসিন্দারাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
‘আমাদের অন্য দূত পাঠাবার আদেশ হবে নাকি, মালিক?’
‘তারপরে তাদের উত্তর নিয়ে ফিরে আসার অপেক্ষায় পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবো? কত দিন অপেক্ষা করবো?’
উজীর আবার কুর্ণিশ করলো তারপর মাফ চাইতে চাইতে পিছু হঠে গেল।
এবারে মির্জার কাছে দিনে আলোর মতই পরিষ্কার হয়ে গেল যে আখসির কেল্লার অবরোধ এড়ানো সম্ভব নয়। ছয়মাস চলার মত খাবার জোগাড় করার আদেশ দিলেন তিনি। কেল্লা উঁচু টিলার ওপর থাকায় সেখানে পানি বয়ে আনার কোন পথ ছিল না। সুঠাম চেহারার যে কোন কাজেই চটপটে ত্রিশ বছর বয়সের কাসেম বেগকে মির্জা নির্দেশ দিলেন কেল্লার ভিতরে আরো একটি পাথরের চৌবাচ্চা বানাতে আর তারপর ভারীর দল ডাকিয়ে চৌবাচ্চাটি কানায় কানায় ভরে ফেলতে।
আমীর-ওমরাহের দলটি নদীর উঁচু পাড়ের ওপর তৈরী পায়রায় ঘরের দিকে চললো, নদীর খাড়া পাহাড়ের ওপর পায়রার ঘরের ঝুলন্ত বারান্দা। আখসি থেকে পাঠানো দূতেরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, এবার ডাকপায়রাগুলোকে কাজে লাগাবেন ভাবলেন মির্জা।
মার্গিলান ও কোকন্দের পথ জানা এই পায়রাগুলোর ওপরই এখন সব আশা। ওদের ধরে, শান্ত করে ডানার ভিতর দিকে গোল করে পাকানো চিঠি আটকে দেওয়া হল। মির্জা ওমর শেখ নিজে হাতে পায়রাগুলোকে আকাশে উড়িয়ে দিতে ভালবাসতেন। আকাশী রংয়ের পায়রাটিকে সাবধানে হাতে তুলে নিলেন তিনি, তারপর কাঠের সিঁড়ি বেয়ে পায়রার ঘরের ছাতে উঠলেন। ধীরে ধীরে, তার রশ্মি পড়ে নীচে, নদীর জল চিকচিক করছে। হালকা বাতাসের নরম স্পর্শ- মুখে যেন রেশমীকাপড় বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। সুদৃঢ় আখসি কেল্লা আর কেল্লার নীচে প্রতিরক্ষার জন্য খোঁড়া গভীর পরিখাগুলো থেকে মির্জা অনেকক্ষণ দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারলেন না। ঐ পরিখাগুলো দুশমনদের লাশে ভরে উঠবে, ভাবলেন তিনি।
কিন’ তিনি বা তার অনুচরদের কেউই সন্দেহ করেনি যে নদীর প্রবল স্রোতে নদীর তীর ছুঁয়ে যেতে যেতে পাথর ক্ষয়ে গিয়ে পায়রার ঘরের ভিত একেবারেই ঝুরঝুর করে দিয়েছে। পায়রাগুলো বুঝতো এই বিপদের কথা। সুন্দর, পরিষ্কার খাঁচার মধ্যে তারা সারারাত ডানা ঝটপট করতো আশংকায়। এখন তারা পুষ্টিকর খাবার বা প্রচুর স্বচ্ছ পানির দিকে মন থাকে না, খাঁচার গরাদ ঠোকরায়, উত্তেজিতভাবে বাইরে যাবার চেষ্টা করে। ওমর শেখের প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে পায়রার রক্ষক জানালো ওদের এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ তারা জানে না। কেবল মির্জা ওমর শেখের হাতে ধরা ঐ আকাশী রংয়ের পায়রাটাই স্বাভাবিক আছে।
ওমর শেখ পায়রার ঘরের ছাতের একেবারে ধারে এগিয়ে গেলেন। এক মুহূর্ত পায়রার নরম ডানাটা ঠোঁটে চেপে ধরলেন, তারপর যেন পায়রাটি বুঝতে পারে এমনভাবে ফিসফিস করে বললেন, ‘উড়ে যা আমার পাখী, মার্গিলান। ভাল খবর নিয়ে আয়…’ তারপর পিছন দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, আপাতদৃষ্টিতে সামান্য এই ধাক্কাতেই পায়রার ঘরের কাঠের ছাত হেলে পড়ল আর মড়মড় শব্দ করে দেয়াল আর বসার দাঁড়গুলি ওপর থেকে নামতে লাগল। প্রথমে ধীরে ধীরে ধসতে আরম্ভ করলেও ক্রমে জোরে নামার পথে ধুলো উড়িয়ে ওমর শেখের ভারীদেহও নীচের দিকে টেনে নিয়ে গেল। চালের আড়ার কাঠ, ভাঙা ইঁট পড়ার আওয়াজ, নদীর আওয়াজ সবকিছুর সঙ্গে মিলে গেল তার মারিয়া চীৎকার আর সবার শেষে তিনি যা দেখলেন তা হল ধুলোর মেঘ ছাড়িয়ে পায়রাটির আকাশের দিকে উড়ে যাওয়া…
৩
ওমর শেখের মৃতদেহ কেল্লার মধ্যে এনে গোছল করানো হলো, মুখ এমন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে যে চেনা যায় না, রেশমী চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে মুখটা। যে বড় ঘরটিতে তারা সবাই মিলে সেহরী করেছে ঘন্টাদুয়েক আগে, সেখানে কুতলুগ নিগার-খানমকে জড়িয়ে ধরে কারাকুজ বেগম আঝোর ধারায় কাঁদছে। খানমের মনে পড়ল আজ মির্জা তাদের সঙ্গে কেমন অদ্ভুতভাবে কথাবার্তা বলছিলেন যেন, যেন তাদের সামনেই অনি-ম ইচ্ছাপত্র লিখছিলেন, মনে পড়ে তারও চোখ জলে ভরে গেল।
‘আশ্চর্য নিজের মৃত্যুর কথা উনি বুঝলেন কী করে? কেমন সব কথা বলছিলেন আজ।’
‘আমার পেটের সন্তান জন্মানোর আগেই তার বাপকে হারালাম আমি, ও খানম।’ করুণসুরে ফিসফিস করে বলল সে।
‘উনি জানতে পারেন কেবল গতকাল সন্ধ্যবেলায়, বললেন, ছেলে হয় যেন!… ছেলে, ছেলে, ছেলে… তার বাপ এখন কোথায়? কোথায়? কেন, কেন আমি মালিকের ঘুম ভাঙালাম? আমি মরলেই তো বরং ভাল ছিল, ঐ খাড়া পাড় থেকে আমার পড়ে যাওয়াই তো উচিত ছিল।’
‘অমন করে বোলো না, বোন আমার! … তোমার সন্তানের জন্যই তোমায় বাঁচতে হবে। আর খাড়া পাড়ের কথা বলছ? আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি খাড়া পাড়ের কাছে। আমাদের সবার সামনেই ভয়ঙ্কর খাড়া পাড়। হায় খোদা!’
স্বামীর এই মৃত্যু কেমন অদ্ভুত, রহস্যময় তাই না? মির্জা ওমর শেখ সাহসী সিপাহসালার, জঙ্গী শাসক, কতবার খোলা তলোয়ার নিয়ে রণক্ষেত্রে ছুটোছুটি করে বেরিয়েছেন- তাতে তার মৃত্যু হয় নি, আর মৃত্যু হল কিনা নদীর পাড় ধ্বসে পড়ে। এটা কি কেবলমাত্র আকস্মিক ঘটনা? এই ঘটনাটি দুর্ভাগ্যের লক্ষণ নয় কি? তার বাপ-দাদার প্রতিষ্ঠিত এই রাজ্যটা তো খাড়া নদীর তীরের কিনারে বানানো এক বাড়ীর মতই? আভ্যন্তরীণ যুদ্ধের দেশটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। কুতলুগ নিগর-খানমের কল্পনায় ভবিষ্যতের ছবিটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠল। সারা শরীর কেঁপে উঠল তার, কারণ তখনি মনে হল একমাত্র ছেলে – আদরের ধন – বাবরের কথা। বাপের জীবন ভেসে গেল প্রচন্ড জলস্রোতে। বাবরকেও কি নির্দয় ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে নাকি?
‘না, না, আল্লাহ তাকে রক্ষা করুন। আমি চললাম বেগম, আন্দিজানে দূত পাঠাব। আমাকে নিজেকেই ছেলের কাছে পাঠাতে হবে তার বাপের মৃত্যুর খবর।’
কারাকুজের কাছে মাফ চাইলেন। মরহুম বাদশাহের দ্বিতীয় স্ত্রীর বিশ্বস্ত লোক কাসেম বেগ পৌঁছে দিতে পারবে দুঃখ আর আশংকায় ভরা কুতলুগ নিগার-খানমের চিঠি তার মা এহসান দৌলত বেগমের হাতে, যিনি বাবরের সঙ্গে আন্দিজানের কাছে বাগানবাড়ীতে থাকেন।
ঠিক সেই সময়, যখন কাসেম বেগ খানমের চিঠিটা হাতে পেল, ঠিক তখনই ফতেমা-সুলতানের নির্দেশে সুলতান আহ্মদ তনবাল গোপনে ততক্ষণে সির-দরিয়ার সেতু অতিক্রম করেছে, দ্বিতীয় দূতের থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে। কারোর চোখে বিশেষ না পড়ার জন্য সে সঙ্গে নিয়েছে মাত্র একজন অনুচর। আজ ফাতেমা-সুলতান তাকে অনেক ওমরাহদের মিলিত করতে পারে, তখ্ত থেকে মির্জা বাবরকে সরাতে দরবারে এত বছর ধরে সে দ্বিতীয় সারির আমীর হয়েই রয়ে গেল। হয়েছে – আর না! যদি জাহাঙ্গীর তখ্তে বসে তাহলে সুলতান আহ্মদ তনবাল হবে উজীরে আজম। আর বালক বাদশাহের উজীরে আজম হওয়া… নিজে শাসক হওয়ারই সামিল নয় কি? তখন… আর খানজাদা বেগমের তসবীরের পিছনে ছুটে বেড়াতে হবে না। খানজাদা বেগমকেই পাবে সে! এমন সুন্দরী মেয়ের মালিক হওয়ার চেয়ে সুখের আর কোন স্বপ্নই হতে পারে না আহ্মদ তনবালের কাছে। পিছন ফিরে তাকাল সে, নিজের ফেলে আসা পথের দিকে। জনশূন্য সে পথ।
এর কয়েক ঘন্টা পরে কেবল কাসিমবেগ রওনা দিল আখসি কেল্লা থেকে। মির্জা বাবরেরও সমর্থনকারী ছিল বেশ কিছু তাদের একজোট করে উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের জন্য প্রস্থত করতে হবে।